আমাদের দেশে প্রতি বছর এইডস এ মৃত্যু হয় গড়ে ষাট হাজার জনের। ক্যান্সারে প্রায় পাঁচ লক্ষ জনের। ম্যালেরিয়া,ডেঙ্গু,চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজারের কম, যদিও এগুলির মহামারী রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েই যায়। অন্যপক্ষে সাপের দংশনে বাৎসরিক মৃত্যুর হার সরকারী হিসেবে পঞ্চাশ হাজার হলেও বেসরকারী হিসেবে এর কয়েকগুন। সাপের কামড়ে অগুনতি মানুষের মৃত্যু হয় তার বেশ কিছু কারনের মধ্যে রয়েছে সাপ সম্মন্ধে গ্রাম ও শহরের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে কুসংস্কার, ভীতি ও সাপ সম্বন্ধে অজ্ঞতা। আজও আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মানুষ সাপে কামড়ালে সঠিক সময়ে হাসপাতালে না গিয়ে হাজির হন ওঝা, গুনীন, পীর, ফকির বা মনসা থানে। অর্থাৎ সাপের কামড়ের পর সুষ্ঠ ও বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা, পরিষেবা না নেওয়ায় সাপে কাটা রোগীর মৃত্যুর প্রধান কারণ।
অল্প কথায় চেষ্টা করা হলো কি ভাবে সাপের কামড় এড়ানো যাবে, কামড় বসালে কি করব এবং কি করব না।
যাইহোক উপরের পরিসংখ্যানগুলি এইটে বোঝাবার জন্যই দেওয়া হল যে সর্পদংশনে মৃত্যু আমাদের দেশের একটি গুরুতর সমস্যা।
শুধুমাত্র সচেতনতা আর WHO-এর নির্দিষ্ট আদর্শ বিধি মেনে চললে ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পৃথিবীতে ২৭০০ ধরনের সাপ আছে। যার অধিকাংশ বিষহীন। যাদের বিষ আছে তাদের সবার কামড়ে মানুষ মারা যায় না। ভারতে প্রায় ২৫০ ধরনের সাপ আছে যার মধ্যে প্রায় ৭০ টি বিষযুক্ত এবং তাদের কামড়ে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে প্রধানত চার ধরনের সাপের কামড়ে মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
১।গোখরো (ফনাধর নার্ভ বিষ)
২।কেউটে (ফনাধর নার্ভ বিষ)
৩।কালাচ( ফনাহীন নার্ভ বিষ)
৪।চন্দ্রবোড়া (রক্তকণিকা ধ্বংসকারী)
গোখরা – এটি ভারতের সর্বাধিক পরিচিত সাপ। গ্রাম বাংলায় পুরোনো মাটির বাড়ীতে বাস করেন এমন গৃহস্থের প্রায় পরিবারের সদস্য। ভারতীয় সিনেমা, পূরাণ, উপকথা এবং কিংবদন্তির কল্যাণে শিক্ষিত-অশিক্ষিত প্রায় প্রতিটি মানুষই সাপটি সম্পর্কে (অবশ্য সব সাপ সম্পর্কেই) অসত্য, আজগুবি, অবৈজ্ঞানিক সব ধারণা পোষণ করেন।
অনেকেই এঁকে বাস্তুসাপ বা বাস্তুদেবতা হিসেবে মান্যও করে। আবার সেই সাথে দেখা মাত্র পিটিয়ে মেরে ফেলার রীতিও বেশ জনপ্রিয়। সাপটি গোখরো। চেহারা আর গায়ের রং ভেদে খরিশ, দুধেগোখরো, পদ্মগোখরো ইত্যাদি নামও প্রচলিত। বৈজ্ঞানিক নাম ‘নাজা নাজা’। কেউটের সাথে এর প্রধান পার্থক্য কেউটের ফণার পিছনে একটি গোল ছাপ এর কিন্তু চশমার মত দুটি গোলাকার চিহ্ন। কেউটের চেয়ে বেশি বিষ ধারণ করে। কামড়ে যদি বিষ ঢালতে পারে তাহলে ওঝা-গুনীন-মনসারথানে নিয়ে গেলে মৃত্যু অবধারিত। ১০০ মিনিটের মধ্যে সাপেকাটার চিকিৎসা হয় এমন হাসপাতালে নিয়ে গেলে বাঁচার পুরো সম্ভাবনা থাকে।
কেউটে – এটি পৃথিবীর সুন্দরতম জীবেদের একটি। প্রাণীটি সর্বকালে সর্বদেশে মানুষের মনে ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রোক্ত নটি ভাবের মধ্যে চারটি- ভয়, বিস্ময়, জুগুপ্সা এমনকি রতি ভাবের উদ্রেক করে এসেছে। ফণাধর সাপ মাত্রই বিষধর। এদের বিষ নার্ভবিষ (নিউরোটক্সিক)। এই সাপটির বাংলা নাম কেউটে। রাঢ় বাংলায় একে ‘কেলে সাপ’ও বলে। বৈজ্ঞানিক নাম ‘নাজা কেউটিয়া’। সাধারণত লোকালয়ে থাকে না। ভিজে জলযুক্ত জমি বা জমির আলে থাকে। সাধারণত নিজে থেকে কামড়ায় না। তবে দক্ষিণরাঢ় অঞ্চলে সাপটি বেশ চঞ্চল এমনকি বিরক্ত হলে তেড়ে এসে কামড়াতে পারে। কামড়ে যদি বিষ ঢালতে পারে তাহলে কোনো ওঝা, গুণীন, জড়িবুটির সাধ্য নাই সাপেকাটা লোকটিকে বাঁচায়। তবে সাপে কামড়ানোর চিকিৎসা হয় এমন হাসপাতালে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে নিয়ে গেলে বাঁচার সম্ভাবনা একশ শতাংশ। সাপটি মানুষের, বিশেষত কৃষকদের অশেষ উপকার করে শষ্য নষ্টকারী প্রাণীদের খেয়ে। এক একটি ফণাধর সাপ বছরে প্রায় ৩০০টির বেশী ইঁদুর খেতে পারে।
অকারণে দেখামাত্র মেরে ফেলা, বিষ এবং চামড়ার চোরাকারবারীদের শিকার হওয়া, বসতির অভাব বা ক্ষতি হওয়ার কারণে এদের সংখ্যা বিপজ্জনক ভাবে কমে যাচ্ছে। খুব দুঃখের কথা। আসলে মানুষ পৃথিবীর একমাত্র আত্মঘাতী প্রজাতি।
চন্দ্রবোড়া – যে চার ধরণের বিষধর সাপের কামড়ে পশ্চিমবঙ্গে মানুষ মারা যায় এই সাপটি তাদের অন্যতম। এটি চন্দ্রবোড়া । বৈজ্ঞানিক নাম ‘দাবৈয়া রাসেলি’। সাপটি অন্য তিনটি বিষধর সাপের থেকে আলাদা রকমের এই অর্থে যে এটি একটি আলাদা গোত্র, “ভাইপারিডি”র অন্তর্গত এবং এর বিষ প্রধানত রক্তবিষ (হিমোটক্সিক), অবশ্য এদের বিষে কিছু নার্ভবিষের (নিউরোটক্সিক) উপাদানও থাকে। এর বিষ রক্ত জমাট বাঁধার ওপর ক্রিয়া করে সেজন্যে কামড়ানোর কিছুক্ষন পরে লক্ষ্মণ হিসাবে মাড়ি বা দেহের অন্য অংশ, মুত্রে রক্ত আসে। এর বিষের ক্রিয়া বহুদিন পর্য্যন্ত থাকতে পারে এবং কামড়ানোর জায়গা থেকে ক্রমশ দেহকোশের ‘নেক্রোসিস’ হয়ে ঘা, ফোস্কার মত ঘা, বা মাংস ‘পচে যাওয়া’র মত ভয়ংকর লক্ষ্মণ দেখা দেয়। এর বিষ কিডনির ক্রিয়াশীলতা নষ্ট করে দেয় ফলে ডায়ালিসিস করতে হয়। চন্দ্রবোড়া ঝোপেঝাড়ে, মাঠে-জমিতে, বাঁশঝাড়ের নীচে শুকনো ডালপালা পাতার আড়ালে থাকে। খুবই ধীরগতি, নড়াচড়া করতে পছন্দ করে না। বিরক্ত না করলে কামড়ায়ও না। তবে কামড়ানোর সময় এর ছোবলের গতি বিদ্যুতের মত। বিরক্ত করলে এই সাপ খুব জোরে হিস হিস শব্দ করে। চন্দ্রবোড়ার গায়ের রং মেটে। গায়ে তার উপবৃত্তাকার চাকা চাকা দাগ চাঁদের মত সেজন্যেই চন্দ্রবোড়া নাম। প্রজননের সময় এরা একসাথে ১৫- ২০ টি বাচ্চা প্রসব করে । জন্মাবার সাথে সাথেই এরা সাবালক হয়ে ওঠে । তাই একই জায়গায় এদের অনেক চন্দ্রবোড়ো সাপের কথা জানা যায়। আমাদের রাজ্যে চন্দ্রবোড়ার মত দেখতে দুটি নির্বিষ সাপ আছে। তুতুর, যেটি ধুলোবোড়া, কাদাবোড়া ইত্যাদি নামেও পরিচিত (indian sand boa) আর ময়াল সাপের (python) খুব ছোট বাচ্চা। তবে চন্দ্রবোড়ার চাকা দাগগুলো সম্পূর্ণ উপবৃত্ত অন্যদের দাগগুলো সম্পূর্ণ নয়। এইটাই চন্দ্রবোড়া চেনার সহজ উপায়। চন্দ্রবোড়া থেকে সতর্ক থাকুন, দূরে থাকুন। মারবেন না দয়া করে আর কামড়ালে ব্লক হাসপাতালে নিয়ে যান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনক্রমেই কোনো জড়িবুটি, টোটকা, first aid দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। ওঝা গুনিনের কাছে নিয়ে যাবেন না। ওঝার বাড়ি যমের বাড়ির বৈঠকখানা ছাড়া আর কিছু নয়।
কালাচ – কুখ্যাত ‘গ্যাং অব ফোর’এর চতুর্থ সদস্যের ছবি এটি (কালো রংয়েরটি)। যে চারটে বিষধর সাপের কামড়ে প: বঙ্গে মানুষ মারা যায় ইনি তাঁদের অন্যতম। কেউ কেউ এটিকে রহস্যময় সাপ বলেন। এই ফণাহীন, কালো কুচকুচে, লিকলিকে, অন্যদের তুলনায় রোগাপটকা সাপটিই কিন্তু আমাদের রাজ্যে সর্পাঘাতে মৃত্যুর সিংহভাগের নায়ক। এর নাম কালাচ। স্থানভেদে কালচিতি বা ডোমনা চিতি নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম “বাঙ্গারুস সেরুলিয়াস(কেরুলিয়াস)। এটি একমাত্র বিষধর সাপ যে কিনা মানুষের সঙ্গ পছন্দ করে। এরা নিশাচর। গভীর রাতে বেরিয়ে গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঢোকে, ঘরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়, সুযোগ পেলে বিছানায় উঠে পড়ে। বালিশের নীচে, মাদুর, চ্যাটাই, সতরঞ্জি বা গোটানো বিছানার মধ্যে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকে। এটিকে রহস্যময় সাপ বলার কারণ হচ্ছে এই সাপটির কামড়ের দাগ প্রায় দেখা যায় না, এর কামড়ে কামড়ানোর জায়গায় কোনো ব্যথা, জ্বালা, যন্ত্রণা রক্তপাত ইত্যাদি কোনো লক্ষ্মণই সাধারণত প্রকাশ পায় না। দংশনস্হানে কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না পেটে ব্যথা, গাঁটে গাঁটে ব্যথা, খিচুনি কিংবা শুধুমাত্র দুর্বলতা অনুভব করার লক্ষণের সাথে দুচোখের পাতা পড়ে আসা নিশ্চিত কালাচের কামড়ের লক্ষণ। এমনকি দেখা গেছে ঘুমন্ত মানুষ এই সাপের কামড়ে ঘুমের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। কালচের বিষ নার্ভবিষ অর্থাৎ নিউরোটক্সিক। এই সাপের খুব সামাণ্য পরিমাণ বিষ একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মৃত্যু ঘটায়। তবে এই সাপের কামড়ের লক্ষণগুলি বেশ বিভ্রান্তিকর। এর কামড়ে তলপেটে ব্যথা, গলায় ঢোক গিলতে কষ্টের মত লক্ষণ যা ডাক্তারবাবুদেরও বিভ্রান্ত করে। ফলে চিকিৎসা বিভ্রাট ঘটে। কোনো আপাত কারণ ছাড়া এই সব লক্ষণগুলোকে রোগীর পরিবেশ এবং পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিবেচনা করে কালাচের কামড়ের সম্ভাবনা ভেবে দেখা দরকার। কালাচের মৃত্যুঙ্করী কামড়ের হাত থেকে বাঁচার প্রধান উপায় সতর্ক ও সাবধান থাকা। গ্রামে মাটির বাড়িতে মেঝেতে বা খোলা জায়গায় বা বারান্দায় যাঁদের শুতে হয় তাঁদের ছেঁড়া ফাটা নয় এমন মশারি বেশ ভালো ভাবে গুঁজে শোওয়া উচিত। আর আগের লক্ষণ আর পারিপার্শ্বিক ঘটনা থেকে সাপে কামড়ানো সন্দেহ হলে বিন্দুমাত্র দেরি না করে হাসপাতালে যেতে হবে। অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে সাপের বিষ থেকে একমাত্র হাসপাতালই বাঁচাতে পার এবং বিনামূল্যে। আর একটা বিষয় আগেই বলা উচিত ছিলো- কিছুটা কালাচের মত দেখতে একটা সাপ গ্রামবাংলায় চিতি, ঘরচিতি, কেঁথোচিতি ইত্যাদি নামে বিষধর সাপ বলে পরিচিত। এর ইংরেজি নাম indian wolf snake. বৈজ্ঞানিক নাম lycodon aulicus. এটি সম্পূর্ণ বিষহীন সাপ। কালাচের সাথে এর একনজরে পার্থক্য হচ্ছে কালাচের গায়ে কালোর ওপর সাদা গোল রিং বা চুড়ির মত দাগগুলো পর পর সারা দেহ ঘিরে একেবারে লেজের শেষ পর্য্যন্ত থাকে। ঘরচিতি কখনোই এত কালো নয়। সাদা দাগগুলো সারা শরীর ঘিরে থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা দাগগুলো লেজের শেষ পর্য্যন্ত থাকে না অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। বাকি তিনটি সাপ কামড়ালে বোঝার অসুবিধা হয় না দু চোখের পাতা পড়ে আসা সব ধরনের সাপের কামড়ের মূল লক্ষণ। ফণাধর সাপের ক্ষেত্রে অসম্ভব জ্বালা যন্ত্রণা ও ক্ষতস্থান ফুলতে থাকে। হাসপাতালে চিকিৎসক শরীর থেকে ২ মিলি রক্ত নিয়ে ২০ মিনিট স্টেটটিউবে কাত করে রেখে রক্ত জমাট বেঁধেছ কিনা। পরীক্ষা করেন চন্দ্রবোড়া কামড়েছে কিনা। চন্দ্রবোড়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসায় দেরী হলেই কেবল ডায়ালিসিস লাগে। সেক্ষেত্রে ডায়ালিসিস হয় এমন বড় হাসপাতালে বিষক্রিয়ার লক্ষণ অনুযায়ী ঔষধ প্রয়োগ করে রেফার করতে হয়। মূলত চন্দ্রবোড়া ও কালাচ সাপকে খেয়ে ফেলা সাপ রাজসাপ বা শাখামুটির সংখ্যাও ভীষণ কমে যাওয়ায় চন্দ্রবোড়া ও কালাচের কামড়ে মৃত্যু হার বেশীরও একটি কারণ। প্রসংগত শাখামুটি সাপের বিষের ধরণ ও কামড়ের লক্ষণ কালাচের অনুরূপ । কিন্তু এদের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে এটা শোনায় যায় না।
সাপ দেখলেই আমাদের ভয় করে। আর কামড়ালে তো কথাই নেই। আক্রান্ত ব্যক্তি এবং আশে পাশে সবার মধ্যে তখন আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আর এই সময়েই প্রয়োজন মাথা ঠান্ডা রেখে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং সর্পদংশনের উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা যেমন AVS ইঞ্জেকশন ইত্যাদি থাকে এরকম চিকিৎসালয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া।
এখন প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে ঠিক কি কি করা উচিত তা বলার আগে কি কি করা উচিত নয় তা জেনে রাখি –
(১)কোন সাপ কামড়েছে তা খুঁজতে ছোটাছুটি করবেন না কারণ বর্তমানে সব ধরনের সাপে একই ধরনের সিরাম ব্যবহার করা হয়। আবার বিষযুক্ত সাপ একবার কামড়ানোর পর ক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে এবং পুনরায় অন্য ব্যক্তিকে ছোবল দিতে পারে।
(২)দাঁতের দাগ দেখে কটা দাগ গণনা করে বা আঁচড় দেখে বিষযুক্ত সাপ না বিষহীন সাপ যাচাই করতে যাবেন না দেখা গেছে আঁচড়ের মতো দাগ কিন্তু মারাত্নক বিষ শরীরে প্রবেশ করেছে আবার প্রচন্ড কামড়েছে কিন্তু বিষ ঢোকেনি।
(৩)কামড়ের স্থানে যন্ত্রণা হচ্ছে কিনা যাচাই করতে যাবেন না। অনেক ক্ষেত্রে ফুলে যায় না বা যন্ত্রণা হয় না, কিন্তু বিষ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে।
(৪)রোগীর শরীরের বিষক্রিয়া লক্ষণ দেখা দিচ্ছে কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না
(৫)আক্রান্ত স্থানে কোন ঔষধ লাগানো বা চিরে দেওয়া চলবে না। ক্ষতস্থান বা তার আশে পাশে বরফ দেবেন না।
(৬)রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এমন কিছু যেমন দড়ি, সাইকেলের টিউব দিয়ে বাঁধন বাঁধবেন না। না হলে পচন শুরু হয়ে যেতে পারে।
(৭)অযথা তাড়াহুড়ো করবেন না। সাপের বিষ কামড়ের পর দ্রুত বেগে ছড়ায় না
(৮)কামড়ের পর দীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছে, রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে, বমি করছে, আচ্ছন্ন হয়ে গেছে – এমন চিকিৎসালয়ে গিয়ে কি লাভ তা ভেবে হতাশ হবেন না। এরকম অবস্থাতেও সঠিক চিকিৎসা হলে অবিশ্বাস্য উপকার হতে পারে।
(৯)সে সময় রোগীকে কোন প্রকারই মাদক দ্রব্য দেওয়া যাবে না।
সব শেষে কিন্তু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ
(১০)কুসংস্কার গুলিকে কোন ভাবেই প্রশয় দেবেন না
কোন মতেই সাপের কামড়ের রোগীকে ওঝার কাছে নিয়ে যাবেন না। আঘাতের জায়গায় তথাকথিত বিষপাথর বসানো, মুরগীর পায়ু কেটে ক্ষতস্থানে বসানো, মুখ দিয়ে ক্ষতস্থান চোষা, পাকা কলার ভেতর কেঁচো পুরে খাওয়ানো, অনেক সময় নিমপাতা চিবিয়ে খেতে বলা হয়, তেতো না লাগলে নাকি বিষাক্ত সাপে কামড়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলি কোনটিই সঠিক নয়।
এই গুলির কোনটি দিয়েই বিষধর সাপ কেটেছে কিনা জানা যায় না বা কোনটিই সাপের বিষকে প্রশমিত করতে পারে না। দৃঢ়ভাবে এই সব পরামর্শ বর্জন করুন।
তা হলে কি করব?
* প্রাথমিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে সব থেকে জরুরী আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাহস দেওয়া। কারণ স্রেফ আতঙ্কেই বহু রোগীর মৃত্যু হয়। বোঝাতে হবে কোন ভয় নেই। সঠিক চিকিৎসা হলে শতকরা একশো ভাগ রোগীই বেঁচে যায়। মনে রাখবেন ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলি AVS প্রয়োগে বিষধর সাপে কাটা ১০০ ভাগ রোগী ১০০%সুস্হ হয়ে ওঠে।
* আক্রান্ত ব্যক্তিকে সম্পুর্ণ বিশ্রামের মধ্যে রাখতে হবে। বক্তিকে যতদূর সম্ভব কম নড়াচড়া করতে দিতে হবে।
* কামড়ানো জায়গায় পরিস্কার জলে ধুতে হবে। সাবান দেওয়া যেতে পারে, বরফ দেবেন না গজ বা ন্যাকড়া দিয়ে ব্যান্ডেজ করা যেতে পারে।
* আগে ধারণা ছিল সাপের বিষ শরীরের ধমনী বা শিরা দিয়ে ছড়ায়। তাই বেশ কষে বাঁধা হত। কিন্তু বিষ আসলে ছড়ায় লসিকা গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে। তাই বাঁধন না দিলেও অসুবিধে নেই। তবে আক্রান্ত স্থানের ঠিক ওপরের দিকে অথবা আশে পাশে ফোলা শুরু হয়ে ফোলার ওপরের দিকে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বা ঐ রকম চওড়া ফিতার মত কিছু দিয়ে (যেমন শাড়ির পাড়, রুমাল) কয়েক পাক বাঁধন দেওয়া যেতে পারে।
* যন্ত্রণা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ট্যাবলেট দেওয়া যেতে পারে।
* সর্বোপরি রোগীকে যতদূর সম্ভব কম নড়াচড়া করিয়ে বিশ্রামের মধ্যে রেখে দ্রুত চিকিৎসালয়ে নিয়ে আসতে হবে। যেমন (১)AVS (২) নিওস্টিগমিন (৩) আ্যট্রোপিন (৪) অ্যাড্রিনালিন আছে AVS দেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সামলাতে বাকিগুলির ও গুরুত্ব আছে।।
* কোন অবস্থাতেই রোগীকে রেফার করতে হলে ১০ভায়াল AVS, নিওস্টিগমিন এবং অ্যাট্রোপিন না দিয়ে রেফার করা যাবে না
* তবু যদি সাপে কাটা রোগীর মৃত্যু ঘটে সরকারী হাসপাতাকে ” মৃত্যুর কারণ যে সাপের কামড়”তা শংসাপত্রে উল্লেখ করবেন। মৃত ব্যক্তির বাড়ির লোক এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন।
সাপের কামড় এড়াতে কি করব?
* রাত্রে আলো ছাড়া পথে হাঁটবেন না। বুট জুতো ও পা ঢাকা পোশাক পরলে সাপ ঠিকমতো কামড়াতে পারে না।
*মেঝেতে না শোয়া ভালো। মশারি ভালো করে টাঙিয়ে গুঁজে নেওয়া উচিত।
* জুতো পরার আগে ভালো করে লক্ষ্য করুন।
*উনুনের ভিতর সাবধানে হাত ঢোকান।
*হঠাৎ সাপের সামনা সামনি পড়ে গেলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। নড়াচড়া না করলে সাপ সাধারণত বুঝতে পারে না বলে কামড়ায় না। তিন চার ফুট দূরে থাকলে না এঁকে বেঁকে টেনে সোজাসুজি দৌড় লাগান। সাপ দ্রুত খুব একটা দূরত্ব যেতে পারে না।
* বাড়ির এলাকা পরিস্কার রাখুন। ঝোপঝাড়, জঞ্জাল, ইট কাঠের স্তুপ সরিয়ে ফেলুন।
* ইন্দুর গর্ত গুলো ভরাট করে দিন।
* পয়োজন হলে কার্বলিক অ্যাসিড, ব্লিচিং পাউডার, গামাকসিন ছড়ান। এসবের তীব্র গন্ধ সাপ তাড়াতে বেশী কার্যকর।
সাপ মেরে ফেলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে আমারা আমাদের ক্ষতি করব না সাপের বিষ মানুষকে মারার জন্য সৃষ্টি হয়নি। সাপের বিষ একটি প্রাকৃতিক নিঃসরণ যা কিছুদিন পরপর সৃষ্টি হয়। সাপের বিষ তার খাদ্যবস্তুকে হজম করার কাজে ব্যবহার করে। মনে রাখতে হবে মানুষ সৃষ্টির অনেক আগেই এই নিরীহ জীবটি পৃথিবীতে এসেছিল।
কেন ওদের মারব না ? – সাপ জীববৈচিত্রের অন্যতম প্রাণী। আর সাপ বিলুপ্ত হলে ধ্বংস হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। একটি সাপ বছরে গড়ে ৩৫০ টি পর্যন্ত ইঁদুর খেতে পারে। সাপ কীটপতঙ্গ, মশার লাভা প্রভৃতি ক্ষতিকারক প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণ করে, সাপের বিষের প্রতিষেধক এ ভি এস তৈরি করা হয়। সাপের বিষ দিয়ে ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিস প্রভৃতি রোগের ঔষধ তৈরীর গবেষণা চলছে।
দেখা গেল যে ভারতের প্রত্যেক বছর বহু হাজার ব্যক্তি সাপের কামড়ে মারা যান। সংখ্যাটা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ হতে পারে। (সঠিক সংখ্যা কখনই পাওয়া যায় না)। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের দেশের থেকে অনেক বেশী বিষধর সাপ থাকলেও মৃত্যুহার গড়ে বছরে ১ জনের ও কম। নির্বিষ সাপের কামড়ে বেঁচে যাওয়ার ঘটনাগুলিতে ওনাদের দাপট বেড়ে যায় ঠিকই। কিন্তু ওঝা গুনিনদের সাধ্য নেই যে বিষাক্ত সাপে কাটা রোগীকে সারিয়ে তোলে। তাই সময় নষ্ট না করে উপযুক্ত প্রাথমিক চিকিৎসা এবং চিকিৎসালয়ে রোগীকে নিয়ে আসলে হাজার হাজার অকাল মৃত্যু রোধ করা যায়। জানা প্রয়োজন বর্তমানে যে পরিমান এ ভি এস প্রয়োগে সাপে কাটা রুগী সুস্থ হয় তার থেকে বেশী পরিমান এ ভি এস প্রয়োগ করতে হচ্ছে আবার তাতেও সে ফল পাওয়া যাচ্ছে না । তার কারণ ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ ভি এস তৈরী হত বেঙ্গল কেমিক্যালে। এখন এই এ ভি এস আসে তামিলনাড়ু থেকে। এই এ ভি এস তৈরী হচ্ছেও ওখানের সাপের বিশ থেকে । ভৌগলিক কারণে বিষের ধর্মের সামান্য হলেও তারতম্য ঘটছে ফলে বাংলার সাপে কামড়ানো বিশের প্রতিষেধক হিসেবে সেরকম মানের ভাল কাজ করছে না। আমাদের বাংলাতেও বাংলার সাপ থেকে সংগৃহীত সাপ থেকে সংগৃহীত বিশের সাহায্যে এ ভি এস তৈরী করানোর জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। আসুন সকলে মিলে সরকারকে বাধ্য করি বেঙ্গল কেমিক্যালে এ ভি এস তৈরী করানোর জন্য। সবার প্রথমে সকলে মিলে সাপের কামড়ে এড়ানোর ব্যবস্থা নিই। সাপে কামড়ালে সাপের কামড়ের চিকিৎসা হয় এমন নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে চলি এবং সঠিক চিকিৎসার সম্পুর্ণ ব্যবস্থা থাকার দাবী জানাই এবং সাপকে সাপের জগতে বাঁচিয়ে রাখি।