পম্পা নন্দী, চিন্তন নিউজ, ৩ জুলাই: নদীই জীবন৷ অথচ স্বচ্ছ কাচের মতো টলটলে সেই প্রাণবারিই এখন রক্তাভ৷ অযোধ্যা পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট নদী আমরুহাসার চেহারায় আমূল বদল৷ নদীর ধারের ঘাসে মড়ক৷ খিদে মেটাতে ঘাস চিবিয়ে মৃত্যুর মুখে চারপেয়ের দল৷ নদীর জল থেকে দূষণ ছড়িয়েছে মানবশরীরেও৷ বিষমিশ্রিত আমরুহাসার জল! সেই নদী এবং জীবন বাঁচানোর তাগিদে এবার পথে নামলেন পুরুলিয়ার আমরুহাসা গ্রামের বাসিন্দারা৷ মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী ৩২ নং জাতীয় সড়ক অবরুদ্ধ হয়ে রইল৷ পরে মহকুমাশাসকের (সদর) উপস্থিতি এবং বিডিও’র লিখিত মুচলেকায় আশ্বাসে অবরোধ উঠল৷
পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল এলাকার বলরামপুর ব্লকের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে একফালি আমরুহাসা নদী৷ তার ধারেই গ্রাম, তার নামও আমরুহাসা৷ এই নদীই লাইফলাইন এখানকার বাসিন্দাদের৷ আগে পানীয় জলটুকুও এখান থেকেই মিলত৷ এখন দৈনন্দিন কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আমরুহাসা৷ এই এলাকাতেই আবার লাক্ষা চাষ হয়৷ রয়েছে লাক্ষা কুঠি৷ স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, লাক্ষা থেকে গালা তৈরির সময়ে ধৌত প্রক্রিয়াটিই নদী দূষণের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ধোয়ার পর বিষাক্ত লাল জল মিশছে নদীতে৷আর তাতেই বাড়ছে দূষণ৷
সমস্যা আজকের নয়৷ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই দূষণ সমস্যায় জর্জরিত আমরুহাসা৷ যার প্রতিফলনও দেখা গিয়েছে নানা ঘটনায়৷ নদীচরের ঘাস মৃতপ্রায়৷ যেটুকু কোনওক্রমে ক্লোরোফিলের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে গবাদি পশুর দল৷ গরুর গায়ে চাকা চাকা দাগ, পিছু ছাড়ছে না মৃত্যুও৷ ক্ষতির মুখে মানবজীবনও৷ নদীর জলে স্নান সেরে মহিলাদের চুল যাচ্ছে উঠে, অনেকের চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে৷ সমস্যা ধরতে পারা মাত্রই আন্দোলনে নেমেছিলেন সেখানকার বাসিন্দারা৷ তৈরি হয়েছে আমরুহাসা জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি৷ বলরামপুর ব্লক প্রশাসন থেকে শুরু করে জেলার সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের জানানো হয় সমস্যার কথা৷ তাতে একটি কাজই হয়েছে৷ নদীর জল রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পরীক্ষা করানো হয়েছে৷ দেখা গিয়েছে, আমরুহাসার জল সিসা এবং ইউরিয়া মিশ্রিত৷ যা মানবশরীরের পক্ষে মারাত্মক বিপজ্জনক৷ এছাড়া অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশ কমতে থাকায় জলজ প্রাণী, উদ্ভিদের আয়ুষ্কালও কমেছে৷ আর তা টের পেয়েই এবার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা আমরুহাসার বাসিন্দাদের৷ নদী বাঁচাতে এবং একইসঙ্গে নিজেদের জীবন সুরক্ষিত করতে পথে নেমেছেন তাঁরা৷
আজ সকাল থেকে প্ল্যাকার্ড হাতে, লাঠি হাতে ধানবাদ-জামসেদপুর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন তাঁরা৷ এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী সংগঠন, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চও৷ যদিও বিজ্ঞান মঞ্চ পথ অবরোধ করে প্রতিবাদের বিরোধী৷ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক নয়ন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘প্রশাসনের আগেই উচিত ছিল, এবিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া৷ যেহেতু বাসিন্দারা নদীটির উপরই নির্ভরশীল, তাই নদী বাঁচাতেই হবে৷’
পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন বলরামপুরের বিডিও ধ্রুবপদ শান্ডিল্য৷ তিনি অবরোধকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে সবটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালান৷ তবে আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, জেলা প্রশাসনের কোনও আধিকারিক গিয়ে প্রতিশ্রুতি দিন, নদীদূষণ রোধে দ্রুত, সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হবে৷ তবেই উঠবে অবরোধ৷ দীর্ঘক্ষণ জাতীয় সড়ক অবরোধের ফলে পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায় যানচলাচল৷
এসব দেখে নড়েচড়ে বসে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন৷ পুরুলিয়ার মহকুমাশাসক (সদর) প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী ঘটনাস্থলে যান৷ তাঁর উপস্থিতিতে বিডিও’কে দিয়ে রীতিমত মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হয় এই মর্মে যে আগামী দেড়মাসের মধ্যে ওই এলাকায় নালা তৈরি করে দেওয়া হবে, যাতে লাক্ষা শিল্পের দূষিত জল নদীতে না মেশে৷ এই লিখিত আশ্বাস পেয়ে বিকেলে অবরোধ তোলেন আমরুহাসার বাসিন্দারা৷ এখন এই আশ্বাসের বাস্তবায়নের উপরই নির্ভর করছে আমরুহাসার ভবিষ্যৎ।