অরূপ সেনগুপ্ত: চিন্তন নিউজ:২৬শে নভেম্বর:– মালিকানাঃ—-
সংবাদ মাধ্যমে সর্বদা সব বিষয়ে প্রকৃত তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় না। সরকার বা সরকারের অধিগৃহীত সংস্থাগুলি থেকেও সর্বদা সব তথ্য সাধারণ্যে জানানো হয় না। তাই কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডের খনিটির বরাত WBPDCL সংস্থাটিকে দেওয়া হলেও, রাজ্য প্রশাসনের তরফে প্রকাশিত তথ্যপত্রে ডেউচা পাচামি খনিটিকে ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনার্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড আর বেঙ্গল বীরভূম কোল কোম্পানি লিমিটেড- এই দুটি সংস্থার যৌথ উদ্যোগ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
সংস্থাঃ
২০১৫ সালে বিশেষভাবে এই উপলক্ষ্যেই তৈরি বেঙ্গল বীরভূম কোল কোম্পানি লিমিটেড (BBCCL) সংস্থাটিকে ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেডের সঙ্গে স্পেশ্যাল পার্পাস ভেহিকল (SPV) হিসাবে যুক্ত করা হয়েছে।
BBCCL সংস্থাটি খনির যাবতীয় প্রাথমিক কাগজপত্র তৈরি, বিভিন্ন দপ্তরের ক্লিয়ারেন্স আদায়, কর্মী নিয়োগ, খরচপত্রের হিসাব, অর্থসংস্থানের তদারকি, প্রযুক্তির পর্যালোচনা আর উপযুক্ত প্রযুক্তি নির্বাচন, এক বা একাধিক উত্তোলক সংস্থার সঙ্গে আলোচনা তথা নিয়োগ, উত্তোলন করা কয়লা বিক্রি বা ব্যবহারের যাবতীয় উদ্যোগ ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা করবে- এটি একটি ব্যবস্থাপক সংস্থা।
যেহেতু এই ধরণের খনির কাজ করার উপযুক্ত প্রযুক্তি অথবা অভিজ্ঞতা দেশীয় কোনো সংস্থার নেই, তাই যথাযথ উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন আন্তর্জাতিক খনি উত্তোলক কোনো সংস্থা আর কোনো অনুসন্ধানকারী সংস্থার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কনসর্টিয়াম তৈরি করে কাজ করা হতে পারে; BBCCL -এর মতে, দক্ষিণ আফ্রিকার স্যাসোল অথবা পোল্যান্ডের খনি সংস্থা- এদের সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে কথা বলা যেতে পারে।
বিনিয়োগঃ
এক্ষেত্রেও বিনিয়োগের পরিমাণ নিয়ে নানা ধরনের বিবৃতি আর ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। উদ্যোগী সংস্থাগুলির প্রাথমিক হিসাব অনুসারে খনির কাজের প্রারম্ভিক বিনিয়োগ আনুমানিক ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। ২০১৬ সালে খনি প্রকল্পের প্রাথমিক ঘোষণা করার সময়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাথমিক বিনিয়োগ ২২ হাজার কোটি টাকা হতে পারে এমনটিই বলা হয়েছিল। যথারীতি বিভিন্ন জনসভা বা সাংবাদিক সম্মেলনে বিনিয়োগের পরিমাণ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এক এক রকম তথ্য দিয়েছেন- ১১ জুলাই, ২০২০ তারিখের বক্তব্য অনুসারে এই পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা, আবার ৯ নভেম্বর, ২০২১ তারিখের কথায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা; কোন্টা সঠিক বোঝা মুশকিল।
কর্মসংস্থানঃ
বিভিন্ন সংস্থার প্রাথমিক হিসেবে মূল খনিতে স্থায়ী আর সাময়িক, অস্থায়ী কর্মসংস্থান, আর সহায়ক (অ্যানসিলিয়ারি) বিভিন্ন উদ্যোগ সব মিলিয়ে ১ লক্ষ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, যদিও এ বিষয়ে বিস্তারিত হিসেব কোনো পক্ষ থেকেই দেওয়া হয় নি।
উত্তোলন প্রযুক্তিঃ
খনির কাজে এইটিই এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সমস্যা হতে পারে।
বলা হয়েছে, কয়লার স্তর রয়েছে মোটামুটি ৬৪০ মিটার নিচে। সাধারণভাবে ৫৫ মিটার পর্যন্ত গভীরে অবস্থিত কয়লা খোলামুখ খনির মাধ্যমে তোলা হয়, তার থেকে গভীর অবস্থানের কয়লা তোলা হয় ডিপ মাইনিং-এর মাধ্যমে। এই ক্ষেত্রে কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই ব্যাসল্ট পাথরের স্তরের নিচে সুড়ঙ্গ কেটে ডিপ মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা তোলা যেতে পারে, কিন্তু তাতে সময় অনেক বেশি লাগবে, আর তা দেশীয় প্রযুক্তিতে সম্ভব নয়। তাঁদের মতে, এখানে খোলামুখ খনি করলে তাড়াতাড়ি উৎপাদন আরম্ভ করা সম্ভব। তবু তা হলেও পাথর (পরিভাষায় ওভারবার্ডেন) সরাতেই তিন বছর লাগতে পারে। কাজটা কঠিন। আর এজন্যই যথাযথ অভিজ্ঞতা আর প্রযুক্তিসম্পন্ন বিদেশী সংস্থার সঙ্গে কনসর্টিয়াম তৈরির কথা বলা হয়েছে। আর সেই কারণে এর পরিকাঠামো আর প্রযুক্তি বিচারে প্রাথমিক বিনিয়োগ তুলনায় অনেক বেশি, আর তার ‘রিটার্ন’ অনেকটাই অনিশ্চিত।
বলা হয়েছে, প্রথমে প্রস্পেক্টিং করে কয়লার স্থানীয় পরিমাণ, তার গুণমান, অবস্থান ইত্যাদি তথ্য যোগাড় করতে হবে। তারপরে তার ভিত্তিতে দরকারী প্রযুক্তি আর খরচের হিসাব করতে হবে। একমাত্র তবেই বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব। অন্যান্য খনির মতো কোনো একটি ছোটো এলাকা বেছে নিয়ে সেখানে বিচ্ছিন্ন একটি প্রাথমিক খনি ইউনিট হিসেবে শুরু করা সমস্যা হবে।
কিন্তু প্রশাসন ইতিমধ্যে ঘোষণা করে দিয়েছে, ছোটো ছোটো ভাগেই খনি করার কথা বলা হচ্ছে; তার প্রথম খনিমুখ হবে দেওয়ানগঞ্জ এলাকায়।
সময়সীমাঃ
সময়সীমা একটা বড়ো প্রশ্ন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতোই ঢাক পেটানো হোক, আজ বা কাল বললেই এই খনি থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি কয়লা পাওয়া আর তা বিক্রি করে টাকার পাহাড় গড়া সম্ভব নয়।
BBCCL সংস্থাটিরই মতে, বন সম্পদ অপসারণের অনুমোদন পেতে আর সেই অনুসারে কাজ করতে কমপক্ষে ২ বছর লাগবে। এই একই সময়ে যদি পুনর্বাসন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়, তবে খনির কাজ শুরু করা যেতে পারে; কিন্তু পুনর্বাসনের প্যাকেজ ঘোষণা হলেও তা চূড়ান্ত হওয়া বাকি আছে, তার সময়সীমা অনিশ্চিত। তারপরে ওভারবার্ডেন সরানোর (পাথর কাটা আর সরানো) কাজেও আনুমানিক ৩ বছর লাগার কথা। তারও পরেই একমাত্র মিলবে কয়লা।
ব্যবহারঃ
সব প্রশ্ন এখনও মেটে নি।
খনিটির বাণিজ্যিক সফলতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, প্রশ্ন তুলছে বাণিজ্য সংস্থা ফিকি (FICCI) ও।
খনিটিকে বাণিজ্যিকভাবে সফল একটি সংস্থান হিসেবে চালাতে গেলে কয়লা শুধু তুললেই চলবে না; তাকে লাভজনক দামে বাজারে বিক্রি করতে, বা তার থেকে নানা বাণিজ্যিক পণ্য তৈরি করে তাই লাভজনক দামে বাজারে বিক্রি করতে না পারলে সংস্থা চলবে না।
কর্তৃপক্ষের প্রারম্ভিক ধারণা ছিল (সংবাদপত্রের রিপোর্ট) খনি থেকে বছরে ২৪ মিলিয়ন (২ কোটি ৪০ লক্ষ) টন (mtpa: million ton per annum)কয়লা তুলে তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে; সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ নিজের দরকার মিটিয়ে বাকি (উদবৃত্ত) বিদ্যুৎ অন্য রাজ্যকে বিক্রি করতে পারে। এভাবে ৫৪০০ মেগাওয়াট (mw: megawatt) বিদ্যুৎ উৎপাদন আর ব্যবহার বা বিক্রি করা যেতে পারে।কিন্তু সে সুযোগ খুব কম। একটা কারণ হল, এই সময়ে নানা কারণে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে শক্তি উদবৃত্ত, বিদ্যুতের চাহিদা শীঘ্রই বাড়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। আর অন্য রাজ্যে রপ্তানির সম্ভাবনাও কম, কারণ গ্রিডে বিদ্যুৎ পরিচালনা করার সুযোগ সীমিত, তাছাড়া অন্য রাজ্যে বিদ্যুতের দাম এ রাজ্যের তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক কম।
তাহলে বিকল্প কী?
বিপুল বিনিয়োগের খরচ তুলে এনে তার ওপরে ন্যূনতম লাভের মুখ দেখতে হলে অন্ততঃ ৩০-৪০ (৩-৪ কোটি) mtpa কয়লা উত্তোলন করতে হবে। বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী তা থেকে মাত্র ৫ mtpa শক্তিক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে; বাকি অন্ততঃ ২৫ থেকে ৩৫ mtpa কয়লা কয়লা হিসেবে বা বিকল্প কোনো পণ্য হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে খোলা বাজারে বিক্রি করতে হবে। জ্বালানী তেল তৈরি ছাড়াও কয়লা ইস্পাত তৈরিতে, সিমেন্ট শিল্পে, কার্বন ফাইবার আর ফোম তৈরিতে কাজে লাগে। তাহলে বাকি কয়লা জ্বালানি (থার্মাল) আর কোক (মেটালার্জিক্যাল) কয়লা এবং অন্যান্য পণ্য হিসেবে খোলা বাজারে বিক্রি করা যেতে পারে।
অর্থাগমের প্রয়োজনে ব্যাসল্ট পাথরও বিক্রি করা যেতে পারে।
কিন্তু এক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে- পদ্ধতিগত সমস্যা। নিয়ম অনুযায়ী ডেউচা পাচামি কোল ব্লকের কয়লা বা তার থেকে তৈরি কোনো পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। তা করতে গেলে কোল ইন্ডিয়ার খনি হস্তান্তরের নিয়ম আর শর্ত পাল্টাতে হবে, আর WBPDCL সংস্থার বাণিজ্যের চরিত্রও পাল্টাতে হবে অথবা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে ব্যবসায় করতে হবে।
সমস্যাটা সত্যিই কঠিন।
শর্তঃ
আর তাই, কাজ শুরু করার আগে ফিকি-র বক্তব্যের নিরিখে রাজ্য সরকার নিশ্চিত করতে চায়ঃ কতো বিনিয়োগের সাপেক্ষে কতো লাভ হতে পারে, কীভাবে টাকা মেটানো হবে- একলপ্তে না কি বাৎসরিক কিস্তিতে, আর খোলা বাজারে কয়লা বিক্রির অনুমতি পাওয়া যাবে কি না।
এই সব প্রশ্নের সমাধানের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে পুরো প্রকল্পটাই।
কিন্তু, কর্ম তো কর্ত্রীর ইচ্ছায়!
ক্ষতিপূরণঃ
বিরোধ অন্যখানেও। ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের পদ্ধতি আর তার পরিমাণ নিয়ে।
৯ নভেম্বর ০২১ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছেনঃ ক্ষতিপূরণের মোট পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা। এমন ভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, যা কি না সারা দেশে মডেল হবে।
• খনি অঞ্চলে অধিগৃহীত জমির বিঘা পিছু ১০ থেকে ১৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। গোয়াল ইত্যাদির জন্য ৫ লক্ষ টাকা আলাদা।
• পুনর্বাসন কলোনির অধিবাসী প্রতি পরিবারের জন্য ৬০০ বর্গফুটের বাড়ি আর সংশ্লিষ্ট জায়গা পাবেন।
• স্থানান্তরিত পরিবারদের জন্য প্রতি পরিবারে এক জনের পুলিশে চাকুরি, আর বছরে ২২৫০০ টাকা।
• ২৮৫টি পাথর খাদানের (যার বেশিটাই অনুমোদন হীন) মালিকেরা প্রত্যেকে জমি আর বাড়ির দাম পাবেন, পাবেন ৫০ হাজার টাকা স্থানান্তরের খরচ আর তাছাড়া চর ময়না ব্যাসল্ট পার্কে জায়গা আর ১০ কিউবিক মিটার ব্যাসল্ট বিনামূল্যে পাবেন।
• পাথর খাদানের ৩ হাজার শ্রমিকের ভরণপোষণ বাবদ ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা।
• এলাকার ২৭টি খনির (অনুমোদিত/অননুমোদিত) মালিকেরা প্রত্যেকে জমি আর বাড়ির দাম পাবেন।
• উচ্ছেদ হওয়া কৃষক প্রত্যেককে এককালীন ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
বাস্তবিক, সিঙ্গুরের কথা মনে পড়লে দোষ নেই।
চলবে——