দেশ

করোনা – লক ডাউন – পরিযায়ী শ্রমিক


সুপর্ণা রায়, চিন্তন নিউজ, ১৩ মে: করোনা সংক্রমণ ও লকডাউন এর জেরে দূর্দশাগ্রস্থ পরিযায়ী শ্রমিকরা। আজ এই দুঃসময়ে প্রত্যেক মানুষের সাথে চরম বিপাকে পড়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকরাও। এরা তো কোন মজা বা দোষ করেনি ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে গিয়ে। এরা নিজেদের রাজ্যে কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে পরিবার পরিজন ছেড়ে ভিন রাজ্যে কাজের জন্য যায়। যারা কাজ পেয়ে যান তাঁদের মালিক পক্ষ আখের রসের মতো ছিবড়ে করে ফেলে। এরা সবথেকে কম খেয়ে, কম শিখে, আর সকলের সেবা কার্য চালিয়ে যান। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে এগারো কোটি।

মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে এস আর জি আর পোলাড নামে একটি স্টিলের কোম্পানিতে কাজ করতো বেশ কিছু পরিযায়ী শ্রমিক। অমানুষিক পরিশ্রম করে দিন গুজরান তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এই সময়ে হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণ এর আঘাত আর তার ফলশ্রুতিতে পরিকল্পনা হীন লকডাউন। কাজ গেল মানুষ গুলোর। কাজ নেই, পেটে খাবার নেই, বাসস্থান নেই। বেশ কিছুদিন ধরে খিদের জ্বালা সহ্য করতে পেটে গামছা বেঁধে দিন গুজরান। সরকারি সাহায্য দূর অস্ত। কোন উপায়ন্তর না পেয়ে নিজের যতটুকু সম্বল ছিল সব বেচে দিয়ে বাসের টিকিট কেটে বাড়ীর পথ ধরেছেন। বাসে উঠার আগে নিজে সংক্রমিত কিনা তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়েছে কষ্টার্জিত কড়কড়ে টাকা খরচ করে। এরা মধ্যপ্রদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন তাঁদের সাহায্য করার জন্যে। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থার গোলামী করতে করতে সরকার সব বোধবুদ্ধি খুইয়েছেন। সরকারের কাছে গরীবদের কষ্টের কোন দাম নেই ও দায়িত্ব ও নেই।

রটানো হয়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই ভুসোওয়াল থেকে স্পেশাল ট্রেন ছাড়বে। কাল মূহুর্ত দেরী না করে বিভিন্ন জায়গার শ্রমিকরা দল গড়ে বাড়ি ফেরার জন্য স্টেশন পথ ধরলেন। কারুর কাছেই ছিল না কোন অনুমতি পত্র। পুলিশ ধড়পাকড়ের আশঙ্কা ছিল। তার সাথে ছিল রাস্তা হারিয়ে যাওয়ার ভয়। তাই রেললাইন ধরে হাঁটা। পূর্ণিমা রাত চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে রেললাইনে। লকডাউন চলছে, তাই তাঁরা ভেবেছিলেন ট্রেন চলাচল বন্ধ। সঙ্গে রুটি, আচার, সংস্থার মাস্ক আর পকেটে সামান্য কিছু টাকা। কারখানা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার হাঁটা হয়ে যাবার পর আর পা চলছিলো না। চুড়ান্ত ক্লান্ত হয়ে রেল লাইনের উপর শুয়ে পড়েছিলেন মানুষ গুলো। এই জায়গাটার নাম কারমাড। ক্লান্ত শরীর, বাড়ী ফেরার চিন্তা, খিদে ও হাঁটা সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিল। ঘুমটাই কাল হলো। ভোরের দিকে একটা মালগাড়ী পিষে ১৬ জন মানুষ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

যাদের জন্য একটি গাড়ি জোটেনি তাদের মৃতদেহ গুলো দেখতে মধ্যপ্রদেশের সরকার হাওয়াই জাহাজ করে মন্ত্রী পাঠিয়েছেন। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেড়মাস অন্তরীণ থাকার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অমূল্য ভাষণ শোনা গেল। প্রথমেই দুষলেন রেলমন্ত্রীকে। অমিত শা জানিয়েছেন এই ঘটনায় তিনি খুব দুঃখ পেয়েছেন। অথচ এর আগে বাড়ী ফেরার পথে হেঁটে, সাইকেল চালিয়ে যথেচ্ছ কষ্ট করা শ্রমিক গুলোর কষ্টের কোন সুরাহা করেননি। চোদ্দো কোটি মানুষের কাজ চলে গেছে, সেই কষ্ট তাঁকে স্পর্শ করে নি। আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এই ঘটনা কেন ঘটলো তার উত্তর দিতে হবে বলে তিনি দুঃখিত ও মর্মাহত।

কিন্তু কেন এই পরিযায়ী শ্রমিকদের বেঘোরে প্রাণ খোয়াতে হলো। এর আগে তিনি একবার ধ্যান করতে বসেছিলেন। এই লকডাউন পরিস্থিতিতে কি তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন? মাঝে মাঝে টেলিভিশনের পর্দায় আসছেন কিন্তু মানুষের জন্য দৃষ্টান্তমূলক কোন ঘোষণা না করে লকডাউন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। অসময়ে মানুষকে থালা-বাটি-ঘন্টা বাজানো বা মোমবাতি জ্বালানোর নিদান দেওয়া কি প্রধানমন্ত্রীর কাজ? প্রশ্ন অনেক কিন্তু উত্তর নেই।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।