কলমের খোঁচা

চে— মুক্তির উন্মুক্ত সকাল — সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:১৫ই জুন:–“চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়—
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর,

তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে ছুটে আসে অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।”
(চে গুয়েভারার প্রতি—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

“হয় স্বদেশ, অথবা মৃত্যু”—চে’ গেভারা। দেশে-দেশে, যুগে-যুগে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত জীবন প্রবাহে মুক্তির উন্মুক্ত ঝড় হয়ে আত্মবলিদানে প্রস্তুত বীর মৃত্যুঞ্জয়ীদের প্রাণীত এই কন্ঠস্বর, এ পৃথিবী তার ‘চলার পথের, পথের ধারে / চেনা বাঁক বা অচেনা মোড়ে’ শুনেছে বারবার। তার যুগ থেকে যুগান্তরে অগ্রগমনের দীর্ঘ সময় সারণী জুড়ে এ বিশ্ব সাক্ষী থেকেছে জন্মগত অধিকার থেকে যুগ যুগ দূরবর্তী- বঞ্চনা আর নিপীড়নের দীর্ঘশ্বাস আবার একদিন তার ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো হঠাৎ জেগে উঠে গরম গলিত লাভায় শত অত্যাচার আর সহস্র অত্যাচারীকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া তাও সে দেখেছে।

“পৃথিবীর ইতিহাসে কবে কোন অধিকার বিনা সংগ্রামে শুধু চেয়ে পাওয়া যায় ?” কিন্তু সাম্রাজ্য লোভী হিংস্র হায়নার রক্ত লোলুপতার সামনে একেবারে মুখোমুখি চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে দানবীয় শোষণের শেকল ছেঁড়া মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা আর মৃত্যুকে অমূল্য জীবন প্রবাহের প্রতিটি মুহূর্তের আনন্দ-উচ্ছাস, বিষাদ-বেদনার সঙ্গে এইভাবে গভীর সংশ্লেষণের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার খুব বেশী সুযোগ এই ধরিত্রী পেয়েছে কী ? সামান্য সময়ের জন্যে সূর্যেরও ঈর্ষার কারন তেজদীপ্ত উপস্থিতি দিয়ে যে ব্যতিক্রমী সুযোগে পৃথিবীকে দিয়ে গেছেন সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের “বীর শহীদ” নায়ক চে’ গেভারা। যিনি তার মুখের চির অমলিন হাসি অক্ষত রেখেই মাথা তুলে বলতে পারেন,“Wherever death may surprise us, let it be welcome”- CHE (April 1967, in message to the Tricontinental- ১৯৬৬, ৩-১৬ জানুয়ারি কিউবার রাজধানী হাভানায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আমেরিকার সবকটি দেশ, আফ্রিকা, এশিয়ার দেশগুলিসহ মোট ৮২ টি দেশের উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সম্মেলনকে বলা হয়ে থাকে Tricontinental )।

কে ছিলেন বিপ্লবী চে’ গেভারা ? পৃথিবীর সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের এক এবং একমাত্র চালিকাশক্তি শ্রেণী সংগ্রাম এই সত্যকে অস্বীকার করেই যারা বামপন্থানুসারী থাকতে চান, তারা মনে করেন আর, শোষণ মুক্তির দুনিয়া জোড়া সংগ্রামে কালে কালে বিশ্বাসঘাতকতার বিশ্বাসযোগ্য পতাকাবাহী সেই তারা আমাদেরও মনে করাতে চান, বিপ্লবী চে’ নিছক একজন কল্পলোকের স্বপ্ন বিলাসী, কেবলমাত্র পুঁথিতে আবদ্ধ এক রূপকথারই নায়ক মাত্র। তাই তার স্থান কেবলমাত্র টি-সার্টে, টুপিতে আর অঙ্গের উলকিতে। আর নরমাংস খাদক লুঠেরা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ তাকে আক্ষায়িত করেছে, দেখাতে আর শেখাতে চেয়েছে আমাদের চে’ একজন খুনি, উগ্রপন্থী ।

আলোহীন, বাতাসহীন নিরন্ন শ্রমিক বস্তিবাসীর অকৃত্রিম বন্ধুতায়, কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত সমাজ বিছিন্ন অসহায়ের আঙুলের ছোঁয়ায় ঐক্য, সংগ্রাম ও মুক্তির সর্বোচ্চ রূপ যিনি সব হারিয়ে সব ফিরে পাওয়ার তীব্র গর্জনে বেপরোয়া সর্বহারা মানুষের মাঝে ক্রমশ জেগে উঠতে দেখতে পেয়েছিলেন, আর তাই তার ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ ঘৃণাভরে হেলায় প্রত্যাখান করে বিশ্বমুক্তির স্বপ্নময় সংগ্রামের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ উত্তাল সমুদ্রে পানসি ভাসিয়ে ছিলেন তিনি স্বপ্ন দেখার এবং দেখানোর প্রত্যয়ী মহানায়ক তো নিশচয়ই, তাইবলে নিছক স্বপ্নবিলাসী ? বীর, যিনি কিনা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় ক্লীব বীরপুঙ্গবদের পরপর ন’টা গরম বুলেট পাঁজরে ধারন করেও হাসিমুখে চেয়ে থাকতে পারেন তিনি খুনি, উগ্রপন্থী ? আসলে তিনি কে ?

৯- ই অক্টোবর বলিভিয়ার সুন্দরী শহর লা হিগুয়েরার নির্জন বধ্যভূমিতে অন্ধকারের জীব লম্পটদের হাতে চে’র হত্যার ঠিক নয় দিন পরে ১৯৬৭ সালের ১৮ ই অক্টোবর ঐতিহাসিক হাভানা বিপ্লবী চক (Havana’s plaza de la)য়ে চে’র জাতীয় স্মরণ সমাবেশে প্রায় দশ লক্ষ মানুষের সামনে তার আবেগ মথিত বক্তব্যে তা প্রাঞ্জল প্রকাশ করেছিলেন চে’র প্রিয়তম বন্ধু, কিউবা বিপ্লবের সহযোদ্ধা সাথী এবং অবিসংবাদী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো,“আমরা যদি এমন একজন মানুষকে আদর্শ করতে চাই যিনি আমাদের বর্তমান সময় থেকে অনেক এগিয়ে আছেন, যাঁর চরিত্রে এবং আচরণে বিন্দুমাত্র কলঙ্ক নেই তাহলে আমার হৃদয়ের গভীরতম অন্তস্থল থেকে আমাকে বলতেই হবে তিনি হলেন চে’। আমরা যদি বলতে চাই আমাদের সন্তান সন্ততিদের মধ্যে আমরা কার ছবি দেখতে চাই তাহলে আমাদের বিপ্লবী হৃদয় সমস্বরে বলে উঠবে,‘আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে চে’কে দেখতে চাই” “চে’ মানে সাহস,চে’ মানে বিপ্লব, চে’ মানে বন্ধু, যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার নামই ‘চে’।”চে মনে করতেন তার কাছে বিপ্লবের অর্থ হলো, এক দায়বদ্ধতা। দায়বদ্ধতা সেই মহান আদর্শের কাছে যা মুক্তির মুক্ত সকাল নিয়ে আসবে, দায়বদ্ধতা সেই মহান রূপকারদের কাছে যাঁরা পায়ে পড়ানো বেরি ছাড়া সবহারানো মানুষের মুক্তির পথের দিশায় প্রথম আলো জ্বেলে ছিলেন, দায়বদ্ধতা সংহতি ও সার্বিক সাম্যের সেই মহান আদর্শের নিশ্চিত বিজয়ের কাছে যা ছিনিয়ে আনার ইতিহাস প্রদত্ত দায়িত্ব আজ বর্তেছে আমাদের ওপর। তাই মার্কসবাদী তত্ত্বের খুবই মনযোগী পাঠক, ঘোরতর আন্তর্জাতিকতাবাদী চে’ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন আর অত্যাচারের অভিন্ন পটভূমিকায় ভিন্নতা নয় এক এবং অভিন্ন অস্তিত্বের বাস্তবতাতেই দেখতে চেয়েছিলেন মহাদেশ দক্ষিণ আমেরিকার মুক্তি সংগ্রামকে। আর তাই আর্জিণ্টিনা, ইকুয়েডর, চিলি, পেরু,পানামা, ভেনেজুয়েলা, মিয়ামি, বলিভিয়া,কিউবা, নিকারাগুয়া—অখন্ড সমগ্র মহাদেশ জুড়েই স্বাধীনতার যুদ্ধ ও বদ্ধন মুক্তির পরিকল্পনাকে বাস্তবে তিনি রূপ দিতে চেয়েছিলেন।

১৯৫৫ সাল মেক্সিকোয় তার পরিচয় হয় বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো ও তার ভাই রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে, এবং তিনি অবলীলায় ঐতিহাসিক ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলনের এক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যান। ক্যারিবিয়ান সাগর উথাল পাথাল করে পৌঁছে যান জল্লাদ বাতিস্তা সরকারের একেবারে চৌকাঠে, শুরু হয়ে যায় জীবন বাজি রাখা কিউবার বিপ্লবী মুক্তি সংগ্রাম। বীরের গৌরব গাথা সেই সংগ্রামের বিজয়ের পরে আবার আমরা দেখি মুক্ত কিউবার মন্ত্রীত্ব, সরকারী সব তকমা হেলায় পরিত্যাগ করে ‘বিপ্লবের ঘোড়া’ চে’ পৌঁছে গেছেন বলিভিয়া, গঠন করেছেন গেরিলা বাহিনী,“এসো মুক্ত করো, মুক্ত করো অন্ধকারের এই দ্বার।” গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাশাস্ত্রের সফল ছাত্র অক্লেশে কাঁধে তুলে নিয়েছেন বন্দুক, শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যুহ রচনা করেছেন, কখনো এগিয়েছেন,কখনোবা পিছিয়েছেন,শত্রুর তপ্ত বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত কমরেডের শুশ্রুষার দায়িত্ব পরম মমতায় নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছেন গাঢ় অন্ধকারে ঘেরা গভীর জঙ্গলে,কখনো চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যাগ ভর্তি করে নিয়েছেন শত্রুর নিশ্চিৎ মৃত্যু পরোয়ানা লেখা গোলাবারুদে, ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে এক সফল চিকিৎসকের মৃত্যুকে হারিয়ে দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী বিপ্লবীতে রূপান্তরের উপাখ্যান। কিন্তু ছেড়ে চলে আসেননি যুদ্ধক্ষেত্র, পীঠে রক্তের দাগ নিয়ে কাপুরূষ পশ্চাদপসরণ নয়, বুকে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে প্রকৃত বীরের মতো সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে তাকে শত্রুর গরম বুলেট। সহযোদ্ধা বিপ্লবী গেরিলা কমরেড শুনেছে তার অকুতোভয় আহ্বান,-“ Bolivia must be sacrificed so that the revolution in the neighboring countries may begin”। বিশ্ববিক্ষায় উজ্জ্বল বিপ্লবী চে’।

আমেরিকা নোয়াতে পারেনি তাঁর মাথা, সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক সরকার বাঁকাতে পারেনি তার শিরদাঁড়া। ৯ অক্টোঃ,১৯৬৭ লা হিগুয়েরা শহরের নির্জন এক বধ্যভূমিতে ক্লীবত্বের আস্ফালন পরপর ন’টি বুলেট অবলীলায় হাসতে হাসতে পাঁজরে ধারন করে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে গেছেন বীর শহীদ নায়ক, “সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত দৃষ্টি”— চে। যে অর্বাচীনের দল উল্লাসে কলম নাচায় আর বলে, চে কমিউনিষ্ট ছিলেন না, ছিলেন না মার্কসবাদে আস্থাশীল তাদের হলুদ চোখে একটু সত্যের প্রলেপ দেওয়া চে’র একটি উক্তি দিয়ে এ লেখার ইতি টানা যেতে পারে, “ Our Revolution has an oblication to the founders of Marxism”। গতকাল আমরা পেরিয়ে এলাম এই বীর শহীদ নায়কের, বিপ্লবের অপর নাম চে’র তিরানব্বই তম জন্মবার্ষিকী।


——————


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।