রাজ্য

বন্ধ জুটমিলের শ্রমিকদের সহায়তায় হাত বাড়ালো চন্দননগর নাগরিক সমাজ।


শঙ্কর কুশারী:চিন্তন নিউজ:৮ই ফেব্রুয়ারি:–মঙ্গলবার ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, আলো ঝলমল মেরীর মাঠে তখন চলছে চন্দননগর বিধানসভা উৎসব । আর ওই একই সময়ে একটু দূরে এই শহরেরই আরেকটি প্রান্তে অবুঝ কান্নায় ভেঙে পড়েছে ভরত ঠাকুরের স্ত্রী আর দুই কন্যা । তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না একটু আগেই চন্দননগর হাসপাতালে মারা গেছেন ভরত । গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ হয়ে থাকা গোন্দলপাড়া জুটমিলের আরো একজন চলে গেলেন চিরকালের মতো, প্রিয়জনদের মায়া কাটিয়ে । এই নিয়ে মিল বন্ধ হবার সময়ে কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত, পেনশনভোগী মিলিয়ে মোট ৪১ জন পৃথিবী ছাড়লেন নিতান্ত অসহায় অবস্থায়, না খেতে পেয়ে, বিনা চিকিৎসায় । ক্রম বর্ধমান সমস্যার চাপ আর হতাশার জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন কর্মচ্যুত শ্রমিক ।

পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কল্যাণ সমিতির আহ্বানে, ৫ ফেব্রুয়ারি, চন্দননগরের নাগরিক সমাজের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ জড়ো হয়েছিলেন জুটমিলটির স্কুল মাঠে । নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এদিন উপস্থিত ছিলেন কুনাল সেন, জগদীশ শর্মা, হীরালাল সিংহ, রতন বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভ্রাংশু কুমার রায়, তুষার ভট্টাচার্য, গৌরীশংকর দে, বিমান দাস, অনন্ত কুমার দে, শংকর কুশারী প্রমুখ ব্যক্তিরা । মাঠে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে শ্রমিকদের সমস্যার কথা শোনেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা । কর্মচ্যুত শ্রমিক রামা চৌধুরীর কন্যার বিবাহ সামনে । তিনি বুঝেই উঠতে পারছেননা কিভাবে কি হবে ! নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে তাঁকে আশ্বস্ত করে বলা হয় তাঁর এই সমস্যার দিনে চন্দননগরের নাগরিক সমাজ তাঁর পাশে আছে এবং থাকবে । ভরত ঠাকুরের স্ত্রী এবং দুই মেয়ের চোখের জল এখনও শুকোয় নি । শোক যাপনের থেকেও তাঁদের কাছে এখন অনেক বেশি করে উঠে আসছে ভবিষ্যতের চিন্তা । তাৎক্ষণিক সংগ্রহের মাধ্যমে সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য করা হয় পরিবারটিকে । জানা যায় গতকাল দুপুরে ভরত যখন অসুস্থ বোধ করেন তখন তাঁদের হাতে গাড়ি ভাড়ার টাকাটুকুও ছিলো না । এক প্রতিবেশীর থেকে দুশো টাকা নিয়ে তাঁকে প্রথমতঃ নিয়ে যাওয়া হয় ভদ্রেশ্বরের ই এস আই হাসপাতালে । কিন্তু যেহেতু গোন্দলপাড়া চটকল দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে সেই কারণে ভরতের চিকিৎসা সেখানে করা যায়নি । তাঁকে তখন নিয়ে যাওয়া হয় চন্দননগর মহকুমা হাসপাতালে । সেখানেই কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয় ভরতের । পরিবারের সদস্যরা এবং প্রতিবেশীরা জানান বেশ কিছুদিন ধরেই চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন ভরত । তাঁর এই অকস্মাৎ বুক ব্যথা এবং হৃদরোগের কারণও ওই ভয়ংকর হতাশা বলেই মনে করেন তাঁরা । ভরতের দুই মেয়েকেই বলা হয়েছে পারলৌকিক কাজকর্ম মিটে গেলে তারা যেন অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কল্যাণ সমিতির অফিসে এসে দেখা করে ।

বিভিন্ন বয়সের কর্মচ্যুত শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারকে এখন গ্রাস করেছে এক ভয়ংকর হতাশা । নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সকলকেই বারেবারে বলা হয় আত্মহত্যা কখনোই কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না । সমস্যার সঙ্গে প্রত্যেককে লড়তে হবে সর্বশক্তি নিয়ে । অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কল্যাণ সমিতি এবং চন্দননগরের নাগরিক সমাজ যথাসাধ্য পাশে থাকার চেষ্টা করবে । শ্রমিক পরিবার এবং প্রতিনিধি স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে জানিয়ে দেয়া হয়, কোন কর্মচ্যুত শ্রমিকের আচার আচরণের মধ্যে কোনরকমের অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করামাত্র কল্যাণ সমিতির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ।

অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কল্যাণ সমিতির এই উদ্যোগের অঙ্গ হিসেবে গোন্দলপাড়া জুটমিলের স্কুল মাঠেই আয়োজিত হয়েছিলো একটি মেডিক্যাল ক্যাম্প । স্থানীয় মানুষদের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ ও প্রয়োজনে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করার জন্য এই স্বাস্থ্য পরিসেবা কেন্দ্রগুলিতে এলাকার বহু মানুষ হাজির হন । উপস্থিত ছিলেন ডাঃ অলোক রায় চৌধুরী, ডাঃ শিপ্রা রায় চৌধুরী, ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও মনোবিদ ডাঃ সৌম্যদীপ কোলে ।

মানুষ যখন একা থাকে, একাকী বোধ করে তখনই তাকে হতাশা গ্রাস করে । দেড় বছরের অধিক বন্ধ হয়ে থাকা গোন্দলপাড়া জুটমিলের কর্মচ্যুত শ্রমিক ও পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়া অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের ক্ষেত্রে সেই ঘটনাটাই ঘটছে, ঘটেই চলছে । কোন নিয়মিত আয় নেই । দোকানদার আর ধার দিতে চায় না । স্কুলে মাইনে দিতে না পারার জন্য ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ । চাঁদা জমা পড়ছে না বলে ই.এস.আই হাসপাতালে চিকিৎসাও আর করানো যাচ্ছে না । কাজের সন্ধানে বেরোতে গেলে যে সামান্য গাড়িখরচটুকু লাগে, নেই এমনকি তার জোগাড়ও । চাল-ডাল কেনার পয়সা কোথায় ? চেয়েচিন্তে যদিবা কিছু জোগাড় হয়ও বা সেটা ফোটানোর জন্য গ্যাস কেনার পয়সা কে দেবে ? বাড়ির মেয়ে বউদের বেরোতে হচ্ছে কাঠ কুড়োনোর জন্য । বাড়িতে অশান্তি, ঝগড়াঝাঁটি হয়ে উঠেছে রোজকার ব্যাপার । পারিবারিক এই অশান্তি থেকে জন্ম নিচ্ছে হতাশা ।

চরম হতাশায় ডুবে থাকা এই অসহায় মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন নিতান্ত নিরুপায় হয়েই । কিন্তু এদিনের এই উদ্যোগের মূল উদ্যোক্তা অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কল্যাণ সমিতি এবং উপস্থিত নাগরিক সমাজের বন্ধুরা মনে করেন না আত্মহত্যা কোন সমস্যা সমাধানের পথ হতে পারে বলে । লাগাতার লড়াই সংগ্রামের মধ্যে থাকলে মনের ভেতরের এই একাকীত্ববোধ দূর হবে এবং প্রত্যেকের মনের মধ্যে এক ধরণের ইতিবাচক চিন্তাভাবনা জন্ম নেবে বলেই মনে করছেন তাঁরা । উপস্থিত মনোবিদ ডাঃ সৌম্যদীপ কোলেও এই একই কথা মনে করেন । শ্রমিক পরিবারগুলিকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে তাঁরা যেন কখনোই মনে না করেন যে তাঁদের পাশে কেউ নেই । অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কল্যাণ সমিতি ও তার সহযোগি সংগঠনগুলি এবং চন্দননগরের নাগরিক সমাজ তাঁদের পাশে সবসময় আছে এবং থাকবে । কোন মূল্যেই এই মৃত্যু মিছিল মেনে নেয়া যায় না । একজন শ্রমিকের জীবন লড়াই সংগ্রামের জীবন । সেই পথ থেকে কখনোই সরে আসা চলবে না । প্রয়োজনে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে ।

অবশ্য প্রশাসনের যে এই সব বিষয়ে নজর দেবার মতো কোন সময় বা সদিচ্ছা নেই সেটাও পরিষ্কার হয়ে যায়, যখন জানা গেলো এদিনের কর্মসূচির পুরোটা মহকুমা শাসকের গোচরে আনা সত্বেও তাঁদের তরফে এগিয়ে আসার কোনরকম উদ্যোগ দেখা গেলো না । ৩১ জানুয়ারি প্রবীণ নাগরিক অধিকার রক্ষা মঞ্চের পক্ষে সংগঠনের সভাপতি বিশ্বজিত মুখোপাধ্যায় একটি চিঠির মাধ্যমে চন্দননগরের মাননীয় মহকুমা শাসককে এই অনুষ্ঠানটির বিষয়ে অবহিত করে অনুরোধ জানান যেন মহকুমা শাসকের অধীনস্ত সমাজ কল্যাণ দপ্তরের পক্ষে কোন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন । চিঠিতে বলা হয়, উদ্যোক্তারা মনে করেন হতাশাগ্রস্ত শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য উৎসাহ জোগাতে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এমন অবস্থায় সরকারি সাহায্য একান্তভাবেই প্রার্থনীয় । কিন্তু এর পরেও কোন প্রশাসনিক হেলদোল দেখা গেলো না ।

চিত্রটা আরও অনেক বেশি হতাশাজনক যখন জানতে পারি যে চন্দননগর পরিবেশ মেলা কর্তৃপক্ষ, চন্দননগর বইমেলা কমিটি, বেশ কয়েকটি পুজা কমিটি এমনকি শহরের হকার সংগঠনের সদস্যরাও এই অসহায় মানুষগুলির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে শহরে হয়ে যাওয়া শ্রমিক মেলা, পর্যটন মেলা অথবা বিধানসভা উৎসবের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে ছিটেফোঁটা সহায়তাও মেলেনি এই হতভাগ্য মানুষগুলির ।

এই অবস্থায় সেদিন উপস্থিত নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রাথমিকভাবে সবুজের অভিযান মাঠে প্রতি বৃহস্পতিবার করে বিকেল পাঁচটার সময়ে একজন মনোবিদ বসবেন । তাঁর প্রধান কাজ হবে নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে হতাশাগ্রস্ত কর্মচ্যুত এই মানুষগুলির মধ্যে জীবনীশক্তি ফিরিয়ে আনা ।

এদিনের মেডিক্যাল ক্যাম্পে প্রায় ১৭০ জনের মতো শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারভুক্ত লোকেদের চিকিৎসা করা হয় এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ওষুধও দেয়া হয় ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।