মিতা দত্ত:নিজস্ব প্রতিবেদন: চিন্তন নিউজ:৫ই আগস্ট:– প্রথম আন্তর্জান্তিকের সাধারন পরিষদের একটি সভা হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন কার্ল মার্কস। কলকাতায় একটি শাখা খোলার প্রস্তাব অনুমোদিত হয় এবং মার্কস মন্তব্য করেন ভারতের শ্রমিক শ্রেনীর আশা আকাঙ্খা এর সাথে ঠিক খাপ খায় এরকম একটি সংগঠন হচ্ছে প্রথম আন্তর্জাতিক।বিভিন্ন জাতীয় ধর্মের মানুষদের তা ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হবে এবং শ্রমজীবিদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার অর্জন করতে সাহায্য করবে।তবে ১৮৮৩ তে মার্কস যখন চোখ বুজলেন তখন ভারতবর্ষে মার্কসবাদী একজনও ছিলেন না বলে মনে হয়।কিন্তু বিংশ শতাব্দীর সূচনা তে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হল। ১৯২০ সালে তাসখন্দে কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকের উদ্যোগে এবং মানবেন্দ নাথ রায়য়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি । চিত্তরঞ্জন দাস ও সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে কমিণ্টানের যোগাযোগ স্থাপনের বহু চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হন ।কলকাতার মুজাফফর আহমেদ,বোম্বাইয়ের এস.এ.ডাঙ্গে এবং মাদ্রাজের সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারি হয়ে ওঠেন তার প্রধান অবলম্বন।
কমরেড মুজফফর আহমেদ ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত এবং বঙ্গে এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।
মুজফ্ফর আহমেদ ১৮৭৯ সালে আজকের দিনে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম জেলার সন্দীপের মুসাপুর গ্রামে মনসুর আলি ও চুনাবিবির ঘর আলো করে পৃথিবীতে আসেন।দরিদ্র পরিবারের সন্তান মুজফ্ফর আর পাঁচটা বাচ্চার মত বেড়ে ওঠেন।তার স্কুল জীবন ও কলেজ জীবনের মধ্যেই সাংবাদিকতার কাজে হাতে খড়ির মধ্য দিয়ে ব্যতিক্রমী ভাবনার পরিচয় দেন।১৯১১ সালে কলকাতায় অবস্থানরত বিভিন্ন মুসলিম ছাত্রের উদ্যোগে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি গঠিত হয়।১৯১৮ সালে সমিতির উদ্যোগে বের হয় বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকার কাজ পরিচালনার সময় চিঠি পত্রের মাধ্যমে তার কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে পরিচয় হয়। ১৯২৩ সালের শুরুর দিক থেকে নজরুল ইসলাম সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতে শুরু করেন এবং যৌথভাবে পত্রিকা প্রকাশনার কাজ শুরু করেন।এইপ্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ধূমকেতু কাগজটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯২২ সালের ১১ ই আগস্ট নজরুল প্রকাশ করেন ধূমকেতু নামক অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা।সম্পাদক রূপে নয় সারথি রূপে নজরুলের নাম প্রকাশিত হয়।কমরেড মুজফফর আহমেদ এই কাগজে “দ্বৈপায়ন” নামে নিয়মিত লিখতেন।প্রকৃতপক্ষে নবযুগ ধূমকেতু,লাঙ্গল,গনবানী প্রভৃতি সাময়িক পত্র গুলো ১৯২০ এর দশকের অবিভক্ত বাংলায় বিশেষ করে কলকাতা ও পার্শবর্তী অঞ্চলে বিপ্লবী জনজাগরন ঘটাতে,শ্রমজীবি মানুষকে সংগঠিত করতে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কন্ঠস্বর তুলতে স্মরনীয় ভূমিকা গঠন করেছিল।
মুজফ্ফর আহমেদের বিপ্লবী জীবনে শিক্ষা ও প্রেরনা, শ্রমজীবি আন্দোলন ও সংগঠনের শত সহস্র যুবক,যুবতী ও কর্মী নেতাদের অগ্রগমনের পথে অমূল্য পাথেয় ।তিনি বলতেন,সর্বহারা বিপ্লবের পথ মসৃন নয়,এ পথে চলতে হলে অসীম ধৈর্য্য শুধু নয়,অপরীসিম বৈপ্লবিক মনোবলের প্রয়োজন।মার্কসবাদ ও লেলিনবাদ তত্ত্বে সমৃদ্ধ হতে না পারলে এই বিপ্লবী মনোবল কখনো সুদৃঢ় হতে পারে না।সারাজীবন বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে তিনি এই পরিচয় দিয়ে গেছেন।আজীবন তিনি পার্টির সবসময়ের কর্মী ছিলেন।
১৯২২ সালের শেষের দিকে কমরেড আবদুল হালিমের সাথ তার দেখা হয়।দুজনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯২৩ সাল থেকে মুজফফর আহমেদ ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হন।বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক আন্দোলনে অংশ গ্রহন করতে থাকেন। ১৯২৩ সালের ১৭ ই মে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আটক হন। ১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং চার বছর তার সশ্রম কারাদন্ড হয়।যক্ষা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি ১৯২৫ সালে মুক্তি পান। এরপর ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে পার্টির কাজ করে বেড়ান।১৯২৯ সালের ২০ এ মার্চ মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে তাকে গ্রেফতার করা হয়।মুক্ত হয়ে শত শত কারামুক্ত বিপ্লবীদের নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন জেলায় পার্টি গঠনের জন্য আত্মনিয়োগ করেন।সেইসময় বিভিন্ন বিপ্লবী জেলে মার্কসবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয় এবং জেলমুক্ত হয়ে পার্টির ছত্রছায়ায় আসেন।এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য সংখ্যা আড়াইশো থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তিন হাজারের ওপর হয়ে উঠে। তিনি দৃঢ়তার সাথে পার্টির সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং গড়ে তোলেন এক সাচ্চা মার্কসবাদী কর্মী বাহিনী। মার্কসবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষার সংগ্রামে তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন। তিনি বলতেন, জনগনের মধ্যে থেকে কাজ না করলে কমিউনিস্ট পার্টিকে বিপ্লবের উপযোগি করা যাবে না ও তার সাথে জোর দিতেন কর্মীদের মার্কসবাদী সাহিত্য অধ্যয়ন,প্রকাশ এবং প্রচারের ওপর।তার ভাবনা বিভিন্ন তার লেখা অজস্র প্রবন্ধও বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন।এনবিএ (NATIONAL BOOK AGENCY) ও গনশক্তি প্রেস মুজফফর আহমেদের চেষ্টার ফসল।প্রেস কাগজ ও বইয়ের দোকান এগুলিকে অপত্য স্নেহ রক্ষা ও পালন করতেন।এইভাবে যে মহান আদর্শের দ্বীপ তিনি ভারতের মাটিতে জ্বেলে ছিলেন সেই দ্বীপ শিখা ভারতের মেহনতি মানুষ্বর জীবনে, শ্রমিক কৃষিকের জীবিনে অনির্বান হিয়ে থাকিবে।সেই দ্বীপ শিখায় সৃষ্টি করবে বিপ্লবের বহ্নিশিখা।