কলমের খোঁচা দেশ

ভগৎ সিং, বিপ্লবের এক নাম।


নিউজ ডেস্ক: চিন্তন নিউজ:২৯শে সেপ্টেম্বর:– ১৯০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিম পাঞ্জাবের লায়লপুর জেলার বংগা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ভগৎ সিং। ভগৎ সিংহের এর পিতার নাম সর্দার কিসান সিংহ সান্ধু ও মায়ের নাম বিদ্যাবতী। ভগৎ সিংয়ের প্রাথমিক পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর স্কুলে পড়ার পালা। ভগৎ সিংয়ের বাবা তাঁকে আর্যসমাজের বিদ্যালয় দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুলে ভর্তি করান। মেট্রিক পাসের পর ভগৎ সিং ন্যাশনাল কলেজে (স্বদেশী বিদ্যালয়) ভর্তি হন। ওই কলেজে পড়াকালে আজীবন সংগ্রামের সাথী শুকদেব, যশপাল ও ভগবতীচরণ ভোরার সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি খুব মনোযোগী ও পরিশ্রমী ছাত্র ছিলেন। ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক পড়াশোনার প্রতি তার আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। সহপাঠীদেরকে নিয়ে নিয়মিত পাঠচক্র করতেন।

ইতালির দেশপ্রেমিক ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডি, আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী ইমন-ডি-ভ্যালেরা ও রুশ বিপ্লবী ক্রোপটকিনের ঘটনাবহুল জীবনের নানা দিক নিয়ে এ সময় পড়েন। আরও পড়লেন ভলতেয়ার আর রুশোর রচনাবলী। লাহোরের ন্যাশনাল ড্রামাটিক ক্লাবের সদস্য হয়ে যুবকদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য অভিনয় করলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত, রাণাপ্রতাপ, ভারত দুর্দশা নাটকে। ভগৎ সিং কিশোর বয়সে লাহোরের ন্যাশনাল কলেজে পড়াশুনা আরম্ভ করেন কিন্তু বাল্য বিবাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং ‘নওজাওয়ান ভারাত সাভা’ (ভারত যুব সভা) এর সদস্য হন।

ভগৎ সিংহের জন্ম একটি জাট শিখ পরিবারে। তার পরিবার পূর্ব থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। কৈশোরেই ভগৎ ইউরোপীয় বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করেন এবং নৈরাজ্যবাদ ও কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন।এরপর তিনি একাধিক বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের (এইচআরএ) সঙ্গে যুক্ত হয়ে মেধা, জ্ঞান ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতায় তিনি অচিরেই এই সংগঠনে নেতায় পরিণত হন এবং সংগঠনটিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে এটিকে হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে (এইচএসআরএ) রূপান্তরিত করেন। তাকে এবং তার সংগঠনকে নৈরাজ্যবাদী আখ্যা দেওয়া হলে তিনি ক্ষুরধার যুক্তিতে তা খন্ডন করেন।

জেলে ভারতীয় ও ব্রিটিশ বন্দীদের সমানাধিকারের দাবিতে ৬৪ দিন টানা অনশন চালিয়ে তিনি দাবী আদায় করতে সমর্থ হন তিনি । প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রায়ের হত্যার প্রতিশোধে এক ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করার অপরাধে মাত্র ২৩ বছর বয়সে ভগৎ সিং এর ফাঁসি হয় পাঞ্জাবের লাহোরে
। তার দৃষ্টান্ত শুধুমাত্র ভারতীয় যুবসমাজকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধই করেনি, ভারতে সমাজতন্ত্রের উত্থানেও সহায়তা করেছিল।

“ব্যক্তিকে সহজেই হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শকে হত্যা করা যায় না। বড় বড় রাজ্য ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে কিন্তু আদর্শ টিকে থেকেছে ঠিকই” – এই অমোঘ সত্যকথন ভারতের মাটিতে উচ্চারিত হয়েছিল যে মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের মুখে, যিনি আজও থেকে গেছেন বিদ্রোহী মানসিকতার প্রতিভূ হিসাবে, তিনি অমর শহীদ ভগৎ সিং।

যে কিশোর মাত্র ১৩ বছর বয়সেই গান্ধীজী পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়, চৌরিচৌরার ঘটনার পরে গান্ধীজী তাঁর আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে অমিতবিক্রম এই তরুণের মনে নানান প্রশ্নের উত্থাপন ঘটে এবং অচিরেই তিনি এমত ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলনের ধারা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। মাত্র ২৩ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে যিনি গড়ে তোলেন বা যুক্ত হন নওজওয়ান ভারত সভা, কীর্তি কিসান পার্টি ও হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের মতো বিপ্লবী সংগঠনের, পারিবারিক শিখ ধর্মের পরিবর্তে নাস্তিকতাকে আশ্রয় করেন, লিখে ফেলেন “কেন আমি একজন নাস্তিক”, “একটি আত্মজীবনীমূলক বক্তৃতা”, “জেল নোটবই ও অন্যান্য লেখক”, “একটি জাতির ধারণা”-র মতো লেখা; তিনিই তো তাঁর সংগঠন হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন-এ সোশ্যালিস্ট শব্দটি জুড়ে সমাজতন্ত্রের আদর্শকে বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তাকে নির্দিষ্ট রূপ দেন।

আজ ভাবতেও অবাক লাগে, এই ধরণের মানুষের উত্তরাধিকার নেওয়ার জন্য, তৎকালীন সময়ে তাঁর আদর্শ ও কর্মকাণ্ডের বিরোধী, শুধু কংগ্রেসই নয়, এমনকি, চরম দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী দল বিজেপি’ও যখন মরীয়া হয়ে ওঠে, তখন এই অসততার বিরোধীতা করাটা আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত মানুষের কর্তব্য। বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে, পুঁজির দালাল হিসাবে চিহ্নিত, কংগ্রেসের পাখসাট থেকে ছিনিয়ে শোষিত মানুষের পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতন্ত্র কায়েমের লড়াইয়ে পরিণত করার যে স্বপ্ন সেদিন ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীরা দেখেছিলেন, তা আজও অধরাই থেকে গেছে। আজ যখন শ্রেণী সংগ্রামের তীব্রতা দূরের কথা, সামান্যতম আঁচ খুঁজে পাওয়াটাও এক সমস্যা; তখন সমাজতন্ত্রের মতাদর্শগত অবস্থানকে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরাটাই আজকের শপথ হওয়া উচিৎ। শুধুমাত্র সংসদীয় চৌহদ্দির মধ্যে আটকে না থেকে, মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তার ইতিহাসনির্দিষ্ট অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে ভগৎ সিং থাকুন আমাদের মননে, শিক্ষায়, অঙ্গীকারে ও মতাদর্শগত সঠিকতায়। সাধারণ মানুষের টাকা নয়ছয় করে কয়েক’শ কোটি টাকার মুর্তি বানিয়ে নয়, ভগৎ সিং-রা থাকবেন আমাদের হৃদয়ে প্রোথিত আদর্শের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা স্বরূপ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।