মিতা দত্ত: চিন্তন নিউজ:৯ই জুলাই:– সামন্ততান্ত্রিক সমাজের নিগড়ে নারী শৃঙ্খলিত। পায়ে বেঁধে দেওয়া হতো নূপুর। এই নূপুরের শব্দে নারীর গতিবিধি নজরে রাখা হত। জমিদার পরিবারে নারীর বিলাসিতার কোনো অভাব ছিল না। অভাব ছিল শিক্ষার।তাঁদের পর্দানসীন করে রাখা হত।কারণ, পুরুষ মনে করত, নারীর কাজ পুরুষের বিনোদন করা, আর সন্তান উৎপাদন করা। সেই অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর জয়যাত্রা সূচিত করেছেন যে কয়জন বঙ্গনারী তাঁদের মধ্যে রানি স্বর্ণময়ী অন্যতম । তিনি শুধু পরিবারের রানি ছিলেন না, তিনি ছিলেন তৎকালীন সমাজের রানি। সংস্কৃতিবান নারী, যে তাঁর সবটুকু দিয়েছেন সমাজ ও শিক্ষার উন্নতিকল্পে।
স্বর্ণময়ীর স্বামী রাজা কৃষ্ণনাথ আলোকোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন আধুনিক শিক্ষার প্রসারের। বংশানুক্রমে তিনি কৃষ্ণকান্ত নন্দীর উত্তরাধিকারী হওয়ায় প্রচুর সম্পত্তির মালিক হন। কিন্ত জমিদারির বিলাসিতা তাঁর চরিত্রে ছিল না। তিনি যথার্থ অর্থেই সংস্কৃতিমনষ্ক ছিলেন। কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষার ফলে, শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতে যে নতুন আলোর স্পর্শ লেগেছিল, তিনি তার ঢেউ বয়ে এনেছিলেন মুর্শিদাবাদে। বিশেষ করে বহরমপুরে। তাঁর সহধর্মিনী অন্দরমহলে জীবন কাটাতে বাধ্য হলেও তাঁর হৃদয়ও আন্দোলিত হয়েছিল সেই নতুন চেতনার আলোয়।
ইতিমধ্যে ঘটল এক মর্মান্তিক ঘটনা, যা সবকিছু ওলোটপালট করে দিল। সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নতুন করে গড়ার কাজ নিজের হাতে তুলে নিলেন অন্তরপুরবাসিনী স্বর্ণময়ী। আবেগপ্রবণ কৃষ্ণনাথ উনিশ বছর বয়েসে জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি প্রথম উইল লিখলেন। সেই উইলে লিখলেন, তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে একটি কলেজ
স্থাপিত হবে। যার নাম হবে ‘রাজা কৃষ্ণনাথ কলেজ’। মহৎ ভাবনা। কিন্তু পরিবারের কথা ভাবেননি তিনি। সে যাই হোক একটি মামলাকে কেন্দ্র করে মিথ্যা অভিযোগের কলঙ্ক সহ্যাতীত হওয়ায় তিনি আত্মঘাতী হন ১৮৪৪ সালের ৩১ অক্টোবর। তার আগের দিন ডেভিড হেয়ারের ভাবশিষ্য রাজা কৃষ্ণনাথ প্রথম উইল বাতিল করে দ্বিতীয় উইলটি করেন। বানজেটিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য তিনি তাঁর জমিদারির প্রায় সব বিষয় সম্পত্তি দান করেন এই দ্বিতীয় উইলে। বিধবা মা ও বিধবা স্ত্রীর জন্য সামান্য মাসোহারার ব্যবস্থা করেছিলেন, ওই উইলে। স্বামীর মৃত্যুর পর সতেরো বছর বয়সের বিধবা স্বর্ণময়ীর শুরু হল নতুন জীবন সংগ্রাম, যা সেই সময়ের ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়।
স্বামীশোকে কাতর হয়ে বসে থাকার সুযোগ তাঁর ছিল না। তাঁকে স্বামীর সম্পত্তি উদ্ধারে মনোনিবেশ করতে হয়। কাজটা যথেষ্ট কঠিন ছিল। মামলা গড়াল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। দৃঢ়চেতা স্বর্ণময়ী ধীরে ধীরে পুরাতন ও বিশ্বস্ত কর্মচারী রাজীবলোচন রায়ের সাহায্যে এই অসাধ্যসাধন করেন। তারপর শুরু হয় তাঁর ভিন্নস্বাদের জীবন।
স্বামীর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে, ১৮৫৩ সালে ‘বহরমপুর কলেজ’ (১৯০২-৩ সালে নাম হয় কৃষ্ণনাথ কলেজ) ও কলেজ স্কুল স্থাপনের জন্য দান করেন ৪০০০ টাকা। পরে কলেজ ভবনের জন্য জমিও দান করেন। বহরমপুর কলেজের অত্যন্ত সংকট দেখা দেয় ১৮৮৬-৮৭ সাল নাগাদ। সংকটাপন্ন মূহুর্তে কলেজকে দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। তখন রানি বার্ষিক ষোল হাজার টাকা খরচ করে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পুনরায় উন্নীত করেন। পরে সেই টাকার পরিমান বেড়ে হয় ২০ হাজার টাকা। ১৮৯৭ সালের ২৫ অগাস্ট কাশিমবাজারের মহারানি প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুর পর বার্ষিক ২০ হাজার টাকা খরচ করে কলেজের পরিচালনার ভার তুলে নেন কৃষ্ণনাথের ভাগ্নে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী।
কৃষ্ণনাথ কলেজ ও কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল ছাড়াও মহারানির দানের হাত প্রসারিত হয়েছিল সারা দেশে তো বটেই, এমনকি আমেরিকা-সহ বিভিন্ন বিদেশেও। কয়েক বছর আগে বহরমপুর শহরের রাস্তার পাশে পানীয় জলের জন্য লোহার ট্যাপ কলছিল। লোকে বলত ‘রানিকল’। আজ থেকে প্রায় পৌনে দু’শো বছর আগে রানি স্বর্ণময়ী সেই ব্যবস্থাটি করেন। অবাক করা কাণ্ড!
দূর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের জন্য তিনি আইরিস ফেমিন রিলিফ ফান্ড, আমেরিকান ফেমিন রিলিফ ফান্ড, মাদ্রাজ ফেমিন রিলিফ ফান্ডের মতো অজস্র খাতে অকাতরে দান করেছেন। রংপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৮৭৮ সালে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের জন্য দু’ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন। শুধু মুর্শিদাবাদে নয়, শিক্ষা বিস্তারের জন্য তাঁর দানের হাত সম্প্রসারিত হয়েছিল সারা দেশ জুড়ে। আলিগড় কলেজ, রাজশাহী মাদ্রাসা, কলকাতা বেথুন কলেজ, বগুড়া ইন্সটিটিউশন, মেদিনীপুর হাইস্কুল, কটক কলেজ, রংপুর হাইস্কুলের অজস্র প্রতিষ্ঠান মহারানির দানে পুষ্ট হয়েছে।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণে দেড়লক্ষ টাকা দেন। কৃষ্ণনগর গভর্মেন্ট কলেজের ভবন নির্মাণের জন্য ৩০ বিঘা জমিদান করেন। এইরকম অসংখ্য ক্ষেত্রে তিনি ভালোবেসে অর্থ দিতেন। এমনকি বিদ্যাসাগর মহাশয়কেও তিনি অর্থসাহায্য করেছেন। বিদ্যাসাগর শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতায় স্বীকার করেছেন সেই ঋণের কথা। মহারানিকে বিদ্যাসাগর এক চিঠিতে লিখেছেন, “লোকের উপকার করিবার জন্যই শ্রীমতীর জন্মগ্রহণ। দেশে অনেক ঐশ্বর্যশালী লোক আছেন। কিন্তু কেহই শ্রীমতীর ন্যায় সর্বসাধারণের যথার্থ ধন্যবাদের আষ্পদ ও উপকৃতবর্গের আন্তরিক আশীর্বাদের ভাজন হইতে পারেন নাই।”
বিদ্যাসগরের ছাপাখানাটিও স্বর্ণময়ীর দানের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার রানির কাছ বিদ্যাসাগর টাকা ধার নিয়েছিলেন। রানি কিন্তু সেই টাকা ফেরত নেননি। বিদ্যাসাগরের মাধ্যমে সেবাধর্ম পালন করার জন্য বিদ্যাসাগরকে নিয়মিত বার্ষিক অর্থ সাহায্য করতেন স্বর্ণময়ী। তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে, বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনে স্বর্ণময়ীর নৈতিক সায় ছিল।
তাঁর অজস্র দানের তালিকায় কিন্তু কোনও ধর্মপ্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায় না। ভাবা যায়, সেই সামন্তযুগে একজন অন্তর্মুখী বিধবা কিভাবে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। অথচ তিনি নিজে ছিলেন অসূর্যম্পশ্যা। । নিজে অন্তঃপুরচারিনী হলেও প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য তাঁর প্রয়াত শ্বশুর হরিনাথ রায়ের মতোই স্বর্ণময়ী প্রতি বছর বিখ্যাত কবিয়ালদের কলকাতা থেকে কাশিমবাজারে এনে কবিগানের আসর বসাতেন।
বর্ধমান জেলার ভাটাকুল নামের একটি গ্রামের দরিদ্র পরিবারে ১৮২৭ সালের ২৬ অগ্রহায়ণ জন্ম হয় অপরূপা সারদা সুন্দরীর। ১২ বছর বয়সের সারদা সুন্দরীর সঙ্গে কৃষ্ণনাথের বিয়ে হয়। বিয়ের পর নিরক্ষর সারদা সুন্দরীর নামকরণ হয় স্বর্ণময়ী। ‘কান্তনামা’ গ্রন্থে স্বর্ণময়ীর রূপের বর্ণনা দিতে লেখা হয়েছে,
“রূপের ছটাতে ঘর হইল উজল। সোবর্ণ পুতলি তনু করে ঝলমল।।”
তার দুই কন্যাসন্তান শৈশবেই মারা গিয়েছে।
তাঁর মহৎ হৃদয়ের মর্মস্পর্শ পেয়ে সবাই কৃতার্থ হয়েছে। কিন্তু এই মহৎপ্রাণ ইতিহাসের গর্ভে বিলীয়মান। তাঁকে নিয়ে চর্চা প্রায় নেই বললেই চলে। হয়তো নারী বলেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁকে নিয়ে ভাবিত হয়নি। এই শতাব্দীতে আজ বহরমপুর সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠার পেছনে যাঁর অসামান্য অবদান, তিনি পেছনেই থেকে গিয়েছেন।
রানী স্বর্ণময়ী দেবীর চর্চার মাধ্যমে নারীরা আজও নতুন করে উজ্জীবিত হবেন। জীবনী চর্চার মাধ্যমে আংশিক ঋণ স্বীকার করা হবে। মানুষ আলোকিত হবেন।