এই তুই ভিক্ষে করিস কেন রে? বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো অনীক। বাচ্চা ছেলেটার হয়তো বছর বারো তেরো বয়স হবে। অপুষ্টির কারণে আরো ছোট দেখায়। সে অনীকের জামা ধরে টেনে পয়সা চেয়েছিল, এটাই অনীকের বিরক্তির কারণ। না হলে সে ভিখিরি দের পাত্তাই দেয় না। পয়সা দেওয়া তো দূর অস্ত। তার মতে ভিক্ষা বৃত্তি একটা অপরাধ।
সে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ছিল। ছড়ানো ছিটানো অনেক লোক। অনীক জামা টেনে ধরা ছেলেটিকে রাগী একটা ধমক দিয়ে দিয়ে বললো – এই জামা ছাড়। একদম গায়ে হাত দিবি না।ছেলেটা জামা ছেড়ে দিল, ঘ্যানঘ্যনানি ছাড়লো না – দুটো পয়সা দাও না, ভাত খাব। অনীকের বিরক্তি বাড়ে, বলে তুই নিশ্চয় নিজের ভিক্ষে নিজে করিস না। তোর একজন মালিক আছে। সে তোদের বাজারে ছেড়ে দেয়, ঠিক কিনা?
ছেলেটি এই কথার উত্তর না দিয়ে একটানা বলে যায় – পয়সা দাও বাবু। অনীক বলে – আমি ভিক্ষে দি না, তোদের সিন্ডিকেট আছে, মালিকরা তোদের কাছ থেকে পয়সা হাতিয়ে নেয়। আমি কিছু দেব না। ভাগ, আগে যা।
ছেলেটি পাশের জনের কাছে চলে গেল। এক ভদ্রমহিলার সামনে হাত পাতল। ভদ্রমহিলা অনীকের দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যি, রাস্তাঘাটে এই এক জ্বালা। দেশটা ভিখিরিতে ভরে গেল। এই সর সামনে থেকে, এখানে কিছু হবেনা ।
(২)
ছেলেটা এর ওর কাছে হাত পেতে বেড়ালো কিছুক্ষণ। নাহ এখানে তার কিছু জুটলো না।সবাই অনীকের রাগে বিরক্তিতে যেন উদ্বুদ্ধ হয়ে গেছে। অনীক যেন ভিক্ষে না দেওয়ার পথ প্রদর্শক। ব্যাপার টা মনে হতে অনীকের হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে দিলো না বলে কেউ দিলো না, সে দিলে কি সবাই দিত ?
কিন্তু না, নীতিগতভাবে সে ভিক্ষা দিতে চায় না।এই সামাজিক অসুখে তার সহানুভূতি নেই। মানুষ কাজ না করে পয়সা উপার্জন করবে কেন? কিন্তু এই বাচ্চাটাকে সে কি কাজের কথা বলবে? শিশু শ্রমিক হয়ে যাওয়ার কথা! সে তো আরও বড় অন্যায় !
ভাবতে ভাবতে অনীক অফিসে গেল। অফিসের নবারুণ তার ভালো বন্ধু। লাঞ্চ ব্রেকে সে নবারুণ কে বললো, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।
তার বলার ভঙ্গিটা কেমনে অস্বস্তিতে ভরা। নবারুণ একটু বিস্মিত হয়ে বলল হ্যাঁ, বলো।
অনীক একটু চুপ করে থেকে বলল – আজ একটা বাচ্চা ছেলেকে আমি ভিক্ষে দিইনি। নবারুণ আরও অবাক হয়ে বলল – তাতে কি হয়েছে?
ছেলেটা বলছিল পয়সা দাও ভাত খাব। আমি ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে খাওয়ার জন্য দুটো টাকা দিতে পারলাম না ! – না দিয়েছো বেশ করেছো। এ নিয়ে অত চিন্তার কী আছে? – না, তাই ভাবছি। – অত ভাবার কিছু নেই। স্যান্ডুইচটা খাও। স্যান্ডুইচটা অনীক কিছুতেই গলা দিয়ে নামাতে পারছে না। চিন্তাটাও মাথা থেকে নামাতে পারছে না। সে একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক নিল। ওষুধ গেলার মতো করে কোনও রকম খাবারটা শেষ করল।
(৩)
তাকে সমানে লক্ষ্য করছে নবারুণ। সে বলল – ভিখিরির চিন্তায় নিজে খেতে পারছো না, এর চাইতে সত্যি ঐ বাচ্চাটাকে পয়সা দিলে ভালো করতে। না, অনীক, এভাবে এই দুনিয়ায় বাঁচা যায় না। এই ভিখিরি দের দেশ থেকে দূর করে দেওয়া উচিত , সমাজের জঞ্জাল ।
- কোথায় যাবে?
- কি ? কে কোথায় যাবে?
- ঐ ওরা? ওদের হয়তো ঘর নেই, রাস্তায় থাকে। কিন্তু একটা দেশ ওদের ও আছে। ওরা এদেশের ফুটপাতে, ফ্লাই ওভারের নিচে স়়ংসার পাতে। দেশ থেকে দূর করে দিলে ওরা কোথায় থাকবে ! নবারুণ মুখ দিয়ে চিক চিক আওয়াজ করে, অনীকের কাঁধে হাত দিয়ে বলে – বড়ো অসুবিধেয় ফেললে হে বন্ধু। শোনো, ওরা মানুষ ই না। কুকুর বেড়ালের মতো থাকে, লোকজন কে ডিস্টার্ব করে। কোনও ভদ্রলোক ওদের নিয়ে ভাবেনা। আমিও ভাবিনা, তুমি ও ভেবোনা। আর একটা স্যান্ডুইচ নাও। পেট ভরে খেলে ভিখিরিদের কথা আপনা থেকেই মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে।
বাড়ি ফেরার পথে বাসে আবার একটা লোক ভিক্ষে করছে। অন্ধ। সমস্ত ভদ্রলোকের মতো অনীকের ও সন্দেহ হলো, লোকটি সত্যি অন্ধ, না অন্ধ সাজছে? সে দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে গিয়ে লোকটার মুখ লক্ষ্য করলো। তার কান্ড দেখে বাসে দুর্বৃত্তদের এক জন যাত্রী মুচকি হাসলো। একজন গলা চড়িয়ে বলল – সত্যি নয়, সত্যি নয়, সব সাজানো। ও আর দেখতে হবে না। কিন্তু অনীক লোকটির মুখ ভালো করে দেখলো, চোখ গুলো কোটরে ঢোকানো, সত্যিই দৃষ্টিশক্তি হীন।সে পকেট হাতড়ালো। একটা দুটাকা কয়েন উঠে এলো। লোকটি লাঠি হাতে একটু দূরে সরে গেছিলো। অনীক তাকে ডাকল – এই শোনো !
লোকটি ফিরল। অনীক তার হাতে কয়েন টা আলগোছে ফেলে দিল। লোকটা হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করে পরের স্টপেজে নেমে গেল। সকালে বাচ্চা টাকে পয়সা না দিয়ে তার মন খুঁত খুঁত করছিল। এখন এই অন্ধ ভিখিরিকে ভিক্ষে দিয়ে তার বিবেকের দংশন যেন কিছুটা হলেও কমলো। কিন্তু ওই বাচ্চাটাও কি আজ ভিক্ষে পেয়েছে? খাবার পেয়েছে? পরের দিন যাওয়ার সময় সে বাসস্টপে অপেক্ষা করছিল, না বাসের নয়, ঐ বাচ্চাটির জন্য, বাচ্চাটি এলো না। বাস এসে গেল। অনিকের মনটা কেন কি জানি খুব ভার হয়ে আছে। সে জানে ভিক্ষা একটা ব্যবসা, একেক জন লোক এই ব্যবসা চালায়। ভিখিরি রা সেই লোকের নীচে কাজ করে। তাদের সারাদিনের ভিক্ষের একটা অংশ সেই লোকটিকে দিতে হয়, সেখানেই এদের খাওয়া থাকা মেলে কিন্তু সে কি রকম খাওয়া, থাকা? অনীকের সকালের ডাল, তরকারি, মাছভাতের মতো? দুপুরের স্যান্ডুইচের মতো? রাতের রুটি তরকারির মতো?
অনীক পরের দিন ও অপেক্ষা করছিল।সেদিন ও বাচ্চাটি এলো না। অনিকের মনটা খারাপ হয়ে গেল, সে কি ওকে ভিক্ষে না দিয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে? ওকে আর কেউ ভিক্ষে দেবে না? এমনি দিন যায় অনীক অপেক্ষা করে, বাচ্চাটি আসে না, অনিকের অপেক্ষা একদিন ফুরিয়ে যায়। কাজের নানা ঝামেলা, তার আর বাচ্চাটির কথা আর মনে নেই। তারপর একদিন ছেলেটি উদয় হলো। সব মনে পড়ে গেল অনীকের। সে লক্ষ্য করলো ছেলেটি সবার কাছে হাত পাতছে কিন্তু তার কাছে এলো না। ওর মনে আছে, অনীক ওকে বকেছিল, পয়সা দেয় নি, সবার কাছে হাত পেতে বাচ্চাটি যখন চলে যাবে অনীকের বাস চলে এলো। তা অগ্রাহ্য করে সে বাচ্চাটিকে ডাকলো – এই শোন! বাচ্চাটি প্রথমে শুনতে পায়নি বা বুঝতেও পারেনি যে তাকেই ডাকা হচ্ছে। অনীক এবার জোর গলায় বলল – এই ছেলেটা এদিকে শোন?
ছেলেটি কাছে এসে দাঁড়ালো আগাপাশতলা দেখলো, একটা হাফ্ প্যান্ট, আর ওপরে বড় সাইজের গেঞ্জি, খালি পা, অনীক জিজ্ঞেস করল – তোর নাম কি রে ?
(৫)
ছেলেটাও তাকে মাপছে, তারপর সে উদাস গলায় বলল – সে অনেক নাম, পয়সা দেবে? অনেক নাম মানে? মা ডাকে মনু, বাবা ডাকে গ্যাঁড়া, মালিক ডাকে হারামজাদা, আরও অনেক নাম ….
স্কুলে গেছিস কোনদিন? নাহ! কেন? পথ শিশুদের জন্য আজকাল কত স্কুল খুলেছে।আমার জানা একটা আছে, এই কাছাকাছির মধ্যে, দিদিরা পড়ায়, যাবি ?
তাহলে ভিক্ষে করবে কে? করবি না ভিক্ষে ! এটা কি কোন একটা কাজ? স্কুলে পড়বি, আঁকা শিখবি, খেলবি, তোর মত অনেক আছে ওখানে। বাচ্চাটি হাত উল্টে গম্ভীর স্বরে বড়দের মতো করে বলল – ওখানে পড়া শিখলে আমি সংসার টানতে পারব না। আমার কাজেই সংসার চলে।অনিক অবাক হয়ে থাকলো। ভিক্ষে একটা কাজ হতে পারে? তা দিয়ে সংসার চালায় এই বাচ্চাটা? দায়ীত্বশীল ছেলের মত কথাবার্তা। অনিক নিজে একটা চাকরি করে, কিন্তু ছেলেটার মত দায়িত্ব তার নেই। সে চুপ করে যায়, তারপর পকেট থেকে দশ টাকার নোট বার করে বলে এই নে।
ছেলেটা অদ্ভুত ভাবে হাসলো, বলল – রোজ দেবে তো? অনীক চুপ করে গেল, সত্যি কি রোজ দশ টাকা দেবে? না তো! অত বড় মন তার নয়।সে বলল ঠিকই বলেছিস, রোজ তোকে দশ টাকা দেব না। কিন্তু তোকে হোমে নিয়ে যাব। ভালো থাকবি, খাবি, ছেলেটি মাথা নেড়ে বলল – তাতে কি হবে? আমার বাবা মা কে দেখবে কে? কেন তোর বাবা, মা কোন কাজ করেন না? করে তো, মা কাগজ কুড়ায় আর বাবা মদ খায়।
(৬)
অনীক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ছেলেটা বলল ঐ দেখ তোমার বাস এসে গেছে। অফিসে যাও, তোমাকেও তো সংসার চালাতে হয়, না কি? অফিস গিয়ে নবারুন কে গিয়ে বলল – নবারুন তুমি তো বিয়ে করেছ? তোমরা দুজনেই কাজ করো, ওতে সংসার চলে তো? তা চলে, তবে এবার একটা গাড়ী কিনব বলে টাকা জমাচ্ছি, লোন ও নেব, হঠাৎ এ প্রশ্ন? আমি সংসার চালানোয় বাবা, মাকে হেল্প করি। কিন্তু যাকে বলে সংসার চালানো সেটা আমায় করতে হয় না, সে তো বিয়ের পরে করবে, নিজের আলাদা সংসার হলে, ঐ বাচ্চাটা কিন্তু এই বয়সেই সংসার চালায় জানো? ওর ভিক্ষের টাকায় ওর বাবা, মা খেতে পায়।
উফ! তুমি মাথা থেকে ওর ব্যাপার টা সরাতে পারছ না কেন বলো তো? অনীক একটু চুপ করে থেকে বলল – নবারুন ও এই বয়সে যা করছে তা আমরাও পারি না। আমি ভাবছি ওকে একটা হোমে ভর্তি করে দেব। কিন্তু তাহলে ওর বাবা, মার চলবে না। কিন্তু নবারুন চুপ করে থাকে, অনীক আবার বলে দেশের লোকের কাজ নেই, তুমি বলেছিলে ওরা জঞ্জাল, ঐ জঞ্জাল আমরাই ফেলে দেওয়া মানুষদের দিয়ে জমিয়ে তুলেছি, ওদের ভিক্ষে দিতে হাত সরে না, নানা রকম ধমক দিই, ওরা অনেক মিথ্যে কথা বলে, কানা, খোঁড়া সেজে ভিক্ষে করে, সেটা মিথ্যে হতে পারে, কি জানো? আমাদের ওদের নিয়ে কোন খারাপ মন্তব্য করা সাজে না, কেন না ওরা এই বয়সে সংসার টানে,আর আমরা গাড়ী কেনার কথা ভাবি, এখানেই সমাজটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এদিক ওদিক যাওয়া টা শক্ত ও আমার জামা ধরে টানলেও আমি ওদিকে যেতে পারি না। আমি ওকে হোমে ভর্তি করে দিলেও ওদিক থেকে এদিক আসতে আসতে পারে না।
সে আবার চুপ করল, তারপর বলল কাল থেকে মেট্রোয় চেপে অফিসে আসব একটু ঘুরপথ হবে, কিন্তু মেট্রো স্টেশনে কোন ভিখিরি থাকে না, পরিষ্কার প্লাটফর্ম। আমাদের সমাজের জঞ্জাল নিয়ে আমাকে আর লজ্জা পেতে হবে না।