শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

উত্তর-আধুনিক মানুষের সামনে এক অভূতপূর্ব বিপদের সূচনা-করোনা ভাইরাস


ডাক্তার রেজাউল করিম:চিন্তন নিউজ:৫ই এপ্রিল:-আরমাগেডো সিনেমার কথা অনেকের মনে থাকতে পারে। মাত্র আঠারো দিন বাদে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এক বিশালকায় পাথরের টুকরো ভেসে আসছে পৃথিবীর দিকে। সবার টান টান উত্তেজনা, বাঁচবে কি পৃথিবী, মানুষের এত গান, হাসি কান্নার ইতিহাস নিমেষে কি হারিয়ে যাবে। মানবসভ্যতার ইতি হবে কি এক টুকরো পাথরের আঘাতে? সিনেমার সেই উত্তেজনা, আশঙ্কা আর আতঙ্ক যেন এখন তাড়া করছে সারা মানব জাতিকে। অথচ, মহামারি কোন নতুন বিষয় নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাচীন মহামারির ইতিহাস। এই চিনেই প্রত্ন অভিযানে আবিষ্কার হয়েছে গণকবরের যা আদিম মহামারির প্রমাণ-হামিন মাঘা আর মিয়াও জিঘোর সেই গণ কবরে শুয়ে আছে কঙ্কালের সারি,সব বয়সের শবের স্তূপ। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ঘটে গেছে একরকম মহামারি। বাইবেলের exodus 9:9 ও আছে সেরকম মারির উল্লেখ।
করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী মহামারী উত্তর-আধুনিক মানুষের সামনে এক অভূতপূর্ব বিপদের সূচনা করেছে। সহস্রাব্দ শুরু থেকে করোনা ভাইরাস নানারূপে বার বার নতুন নতুন আতঙ্কের সূচনা করেছে। উয়ানে প্রথম আক্রমণ শুরু হয়েছিল করোনা ১দিয়ে। এর ফলে প্রায় হাজার দশেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। প্রতি শত সংক্রমিত ব্যক্তির ১১জনকেই এই অসুখ থেকে বাঁচানো যায় নি। ২০০৩ র পর আর এর তেমন নতুন আক্রমণের খবর পাওয়া যায় নি। সহস্রাব্দের প্রথম দশকে করোনা যে নতুন রূপে আবার্ভার হল বিজ্ঞানীরা তার নাম দেন মধ্যপ্রাচ্য শ্বাস-পীড়া (MERS). এর আক্রমণ ছিল আরো ভয়াবহ। আক্রান্ত ব্যক্তির প্রায় শতকরা ৩৬জনের জন্য যা ছিল অত্যন্ত প্রাণঘাতী।সৌভাগ্যক্রমে সে হাজার আড়াই মানুষ মেরে তার বাণ সম্বরণ করেছে। মাঝে মাঝে এরা যে আসে না তা নয়, কিন্তু মহামারি হিসেবে তাদের দেখা পাওয়া যায় না। আরেকটি একই রকম সাংঘাতিক সংক্রমণ নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ সবাই খুব চিন্তিত ছিলেন। তার নাম হল সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস। মহামারী সংঘটিত করে সে কিন্তু বিদায় নেয় নি। প্রতি বছর অন্ততঃ হাজার খানেক মেরে সে ক্ষান্ত হয়, এই যা। এই করোনার বাজারে ও সে আছে, গ্রামে গঞ্জে, গরিবের কুটিরে, বস্তিতে।
এই যে বিশ্বব্যাপী চরম আতঙ্ক ও উৎকন্ঠা তা আক্ষরিক অর্থে সারা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। শেয়ার মার্কেট বড় পতনের সম্মুখীন হয়েছে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধির হার তলানিতে ঠেকেছে, তেলের দাম কমতে কমতে প্রায় দু দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচুতে অবস্থান করছে। এমনকি, পৃথিবী ব্যাপী নিরন্তর যে প্রাণঘাতী যুদ্ধ চলছিল, তার ও সাময়িক বিরতি হয়েছে। সৌদি আরব ও ইয়েমেন এতদিনে শান্তি চুক্তি সই করেছে। যুদ্ধ বিপনন যাদের পেশা তারাও একটু থমকে আছে।
করোনা ভাইরাসের ব্যাপ্তি ও মারন ক্ষমতার সাথে যদি করোনার অন্য জ্ঞাতিগুষ্টির মারণ ক্ষমতার তুলনা করা যায় তাহলে বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। সার্স ও মার্সের মারণ ক্ষমতা কোভিড-১৯র চেয়ে বহুগুণ বেশি। আফ্রিকার গরীব দেশ থেকে যে অসুখ সিয়েরা লিওন, গিনি লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া, মালি, সেনেগাল হয়ে খোদ ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র লণ্ডন, এমনকি আমেরিকা পৌঁছে গেছিল সেই এবোলার মারণ ক্ষমতাও করোনার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এবোলা থেকে যত রোগী ভর্তি হয়েছে তার,শতকরা ৫৬% মারা গেছেন। এবোলা নিয়ে সব তথ্য পাওয়া না গেলেও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলি যে এই সংক্রমণে অর্থনৈতিক ভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও আমেরিকা ও ইউরোপের গায়ে আঁচ তেমন লাগে নি। এবোলার গড় মৃত্যুহার প্রায় ৩৬-৩৭% হলেও বিশ্বজোড়া গেল গেল রব তেমন শোনা যায় নি।
করোনা নিয়ে যে আতঙ্ক ও ত্রাস তার দুটি দিক আছে। প্রথমতঃ এই ভাইরাস ধনী ও নির্ধনকে সমানভাবে আক্রমণ করছে। ইরানের প্রথম সারির এক ডজন ধর্মীয় ও প্রশাসনের কর্তা ইতিমধ্যে মৃত। ব্রিটেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী প্রথম দিকেই আক্রান্ত হন, তারপর একে একে এর শিকারের তালিকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যুবরাজ চার্লস, প্রধানমন্ত্রী জনসন আক্রান্ত হন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তড়িঘড়ি ভাইরাস পরীক্ষা করে নিজেকে ভাইরাস-মুক্ত বলে ঘোষণা করেন। করোনার সম্ভাব্য আক্রমণের ছোবল থেকে যে কেউ মুক্ত নন, তাই সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে। নইলে লাইবেরিয়া বা নাইজেরিয়ার দরিদ্র নিপীড়িত মানুষ যখন আক্রমণে কাবু ছিল আন্তর্জাতিক কলমচিরা তখন রোগনিদ্রায় ব্যস্ত ছিলেন।
করোনার আরেকটি দিক হল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর সংক্রমণের ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি হলেও (Base Reproductive number 2-3) এর মারন ক্ষমতা (CFR) কম। করোনা সাধারনত একটু বয়স্কদের সহজেই কাবু করে ফেলে। বিশেষতঃ যারা অন্য কোন অসুখ যথা ডায়াবেটিস, শ্বাসজনিত পীড়া বা অন্য কোন মারাত্মক অসুখ যা প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এমন অসুখে ভুগছেন। শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর হার নেই বললেই চলে। প্রথম তিনটি দশকের অল্পবয়সী ও যুবাদের মধ্যে এর মারণ ক্ষমতা যেখানে মাত্র ০.২% সেখানে ৬০ বছর বা তার বেশিদের ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ৩৫গুন বেশি। সারা পৃথিবী জোড়া ক্ষমতার চূড়ায় থাকা বৃদ্ধ নেতাদের জন্য এরচেয়ে ভয়াবহ আর কিই বা হতে পারে।করোনার সাম্যবাদী আক্রমণ যেমন একদিকে সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে তেমনি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের কঙ্কালসার চেহারাটাও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে চলে এসেছে। বিশ্বে এক অক্ষের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে সম্পদের অসম বন্টনের ব্যবস্থা করেছে তার সবচেয়ে ভয়াবহ ফল দেখা গেছে জনস্বাস্থ্যে সরকারী বিনিয়োগে। ইন্স্যুরেন্স ভিত্তিক চিকিৎসা পরিকাঠামোর ফলে জনসংখ্যার একটা বড় অংশের কাছেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুফল ধরাছোঁয়ার বাইরে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে উন্নত বিশ্বের পরিকাঠামো, পরিকল্পনা ও খরচের একটি প্রতিবেদন 1988 সালে বের হয়। Future of public health নামক এই সুবিখ্যাত ও বহুপঠিত রচনাটি তৈরী হয় Naional academy of sciences ও Institute of Medicine র উদ্যোগে। তাঁরা তখন মত প্রকাশ করেছিলেন যে উন্নত বিশ্বের জনস্বাস্থ্য হল “ভঙ্গুর”। ২০০২ সালে তাঁরা আবার নতুন করে মনে করিয়ে দেন যে অবস্থার কোন পরিবর্তন তো হয় নি বরং তা আরো বিশৃঙ্খল হয়েছে ও জনস্বাস্থ্যের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও এপিডেমিওলজিষ্টদের যে দল প্রস্তুত করা উচিত ছিল তা হয় নি। একবিংশ শতাব্দীর নতুন নতুন সমস্যা মোকাবিলা করার মত ক্ষমতা তার নেই।সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে তাঁরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেন যে আমেরিকার প্রতি ১০০জন জনস্বাস্থ্য কর্মীর ৪৫ জন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অবসর নেবেন ও তাদের বদলে অন্য কর্মী নিয়োগের কোন পরিকল্পনা নেই। শুধু তাই নয় Government accountability office বলে যে, “no state is fully prepared to respond to a major public health threat”। ফেডারেল সরকারের খরচ বিশ্লেষণ করে জনস্বাস্থ্য বাজেটে বিপুল ঘাটতির যে ভবিষ্যৎবাণী করা হয় দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালে তার প্রতিফলন হয়েছে। এর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বয়স্ক, কম আয়ের মানুষ ও ইন্স্যুরেন্স করার ক্ষমতা নেই এমন মানুষ। ফেডারেল বাজেট ১৩-১৭% কমে যাওয়া ও আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার অপারেশনে প্রচুর খরচ হওয়ার কথাও এই রিপোর্টে উঠে আসে। এই দুটি জায়গায় সরকার যে খরচ করে তার পরিমান ৩২৮বিলিয়ন ডলার যা আমেরিকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরো দুর্বল করেছে। আমেরিকা চিকিৎসার উন্নত পরিকাঠামো তৈরী করে অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলার ব্যাপারে সফলতা অর্জন করলেও জনস্বাস্থ্যে সরকারী বিনিয়োগ কম করার ফলে দরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষ, অনিয়মিত কর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস তার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, কোভিড-১৯ যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অনেকেই খরচের ভয়ে প্রথমদিকে হাসপাতালমুখী হননি।
বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইন্টার আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক ইত্যাদি সংস্থা ল্যাটিন আমেরিকার ১৩ টি দেশে একটি উল্খেযোগ্য সমীক্ষা চালায়। তাঁরা তাদের সুদীর্ঘ্য রিপোর্ট পর্যালোচনা করে মন্তব্য করেছে ১) সরকারী জনস্বাস্থ্য ব্যয় ও বেসরকারি জনস্বাস্থ্য ব্যয় পরস্পরের পরিপূরক নয়।
২) বেসরকারী ব্যয় স্বাস্থ্য সূচক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না
৩) বেশি আয়ের মানুষের খরচ করার প্রবণতা ও তার বিনিময়ে লব্ধ ফল কম আয়ের মানুষের লব্ধ ফল থেকে আলাদা।
৪) বেসরকারী বিনিয়োগ কখনোই চিহ্নিত সূচক (যথা IMR,MMR) অনুযায়ী করা হয় না।
৫)বেসরকারি পুঁজি স্বাস্থ্যকে “বিনোদন পণ্য” বলে মনে করে।
৬) আয় বাড়লেও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়ে না, স্বাস্থ্য বিনোদনে খরচা অবশ্য বৃদ্ধি পায়।
এই রিপোর্টে একটি খুব চিত্তাকর্ষক বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চিত্তাকর্ষক এইজন্য যে বড়লোক দেশ ও গরীব দেশ, ধনী ও নির্ধনের চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়ার মানসিকতা সেখানে ফুটে উঠেছে। স্বাস্থ্য কি কেবলমাত্র একটি ভাবনা নাকি তা মাপার কোন সূচক থাকা দরকার যার দ্বারা বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করা হবে? চুল ট্রান্সপ্লান্ট আর পুষ্টি কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এই সংক্রান্ত বিখ্যাত মারী (Murry1993) রিপোর্ট পড়লে বোঝা যায় যে ধনীরা যে অসুখে ভোগেন ও যা স্বাস্থ্য বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে তা মূলতঃ স্বাস্থ্য বিনোদন। গরিবের জন্য সরকার ইন্স্যুরেন্স এর পথ খোলা রেখেছে। যদি পয়সা খরচ করে কিনতে পারেন তাহলে হাসপাতালের দরজা খুলবে নাহলে বিনা খরচে চিত্রগুপ্তের খাতায় নাম লেখাতে হবে। ঠিক সেই ঘটনাটাই ঘটছে। আমেরিকায় জীবনশৈলী ঘটিত অসুখের প্রাদুর্ভাব, দুর্বল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অত্যধিক চিকিৎসা খরচ এই সবকিছুর মিলিত প্রভাবে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভবিষ্যতে আমেরিকা যদি করোনার নতুন আঁতুড় ঘর হয়ে ওঠে তাহলে তা খুব বিস্ময়কর হবে না। মনে রাখতে হবে যে আমেরিকা কিন্তু সারা বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে যদিও তার পেছনের দর্শনটি হল অতীব অন্তঃসারশূন্য, পলকা ও ভঙ্গুর। করোনায় আমাদের দেশে মৃত্যুহার এখন পর্যন্ত বেশি নয়, আক্রান্তের সংখ্যা ও এখনো মাত্রাছাড়া হয় নি। যদিও আগামী সপ্তাহে এটি একটি সর্বকালীন রেকর্ড করবে ও ভয়াবহতায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলার আশঙ্কা আছে। এ দেশের মূল সমস্যা হল, জনস্বাস্থ্য নিয়ে দেশ নেতা ও সাধারণ মানুষ সমানভাবে অজ্ঞ। নানারকম ধর্মীয় কুসংস্কার ও বিচিত্র নারকীয় চিকিৎসা পদ্ধতি অবস্থা আরো জটিল করে তুলেছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে স্বাস্থ্য বিনিয়োগ। এদেশে ভোট না এলে দেশের কর্তাদের জাতীয় কর্তব্য নিয়ে মাথা ব্যাথা থাকে না। জনসংখ্যা যেমন একটা বড় সমস্যা তেমনি বড় সমস্যা হল সুস্পষ্ট স্বাস্থ্য নীতির অভাব। সংক্ষেপে কয়েকটি উল্খেযোগ্য বিষয়ে আলোচনা করা যায়।
১) স্বাস্থ্য বিনিয়োগঃ
সারা বিশ্বে জিডিপির নিরিখে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যয় সবচেয়ে কম। (শতকরা একভাগের কাছাকাছি।)। মোট খরচের 85.6% ভোক্তার নিজস্ব ব্যয় (out of pocket expense)
-বাজেটের মাত্র 35% অর্থ জনস্বাস্থ্যে খরচ হয়। দরকার 80%-দেশে প্রতি 10,000 জনসংখ্যা পিছু ৭জন চিকিৎসক ও 17জন নার্স আছেন। দরকার ১৪জন ডাক্তার ও ২৯জন নার্স।
-নার্স ও ডাক্তারের অনুপাত আছে ০.৬:১। দরকার ৩:১
ডাক্তারদের মাত্র ২০% গ্রামে আছেন। গ্রামীন জনসংখ্যা ৭০%
দেশে যেসব রোগে মানুষ মারা যান আর যেসব রোগ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির আওতার বাইরে তার মধ্যে সুন্দর সাদৃশ্য আছে। ইন্স্যুরেন্স কভারেজ পেতে হলে রোগী যখন ইন্স্যুরেন্স করছেন তখন কোন দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগলে চলবে না। তার জন্য প্রিমিয়াম বেড়ে যাবে বা সুবিধা আদৌ পাবেন না। প্রধানমন্ত্রী যে যোজনা ঘোষনা করেছেন সেখানে মোট পাঁচ লক্ষ টাকার সুবিধা পাওয়া যাবে। দেশে পরিবারের গড় সাইজ ৪.৮ অর্থাৎ মাথা পিছু ১লক্ষ টাকা। যেহেতু, সরকারী ব্যবস্থায় শয্যার আকাল (প্রতি ১০০০০ মানুষ পিছু ৭টি শয্যা আছে) তাই ঐ সামান্য টাকা দিয়ে যে চিকিৎসা সম্ভব হবে না তা সহজেই অনুমেয়।
এই দেশে বয়স্কদের যে কয়েকটি রোগে মৃত্যু হয় তার একটা তালিকা দেওয়া যেতে পারে।
(IHD-15.4 লাখ ,COPD 9.6 লাখ,Cancer 7.8 লাখ,Stroke 7.3 লাখ,Diarrhoea 7.2 লাখ
Respiratory infection 5.1 লাখ,TB 4.3 লাখ
Asthma 2.5 লাখ,Diabetes 2.5 লাখ)
প্রতি বছর ১০০০ সোয়াইন ফ্লুতে, ১২১৫৪ তড়িদাহিত হয়ে,১২৭৪৮ জন এক্সিডেন্টে,২০২০১ জন ছাদ থেকে পড়ে,২১৬৪৬ জন বিষ খেয়ে,৩০১৮৭ জন জলে ডুবে মারা যান। প্রতিদিন প্রায় ৬০০ টিবিতে ও সমসংখ্যক মারা যান স্রেফ না খেতে পেয়ে। জনসংখ্যার ৫৯ ভাগ রক্তাল্পতায় ভোগে ৩১% বাচ্চা দুবেলা খেতে পায় না, আর মোট শিশু মৃত্যুর 32 ভাগ শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় মারা যায়।
এই তালিকাটা সরকারের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। এই তালিকা দেখলে সহজে অনুমান করা যায় যে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী না করতে পারলে দেশের এই মৃত্যুমিছিল বন্ধ হবে না। মারন রোগের বেশিরভাগ গরীব মানুষের, কিছু কিছু পুষ্টির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। অনেকগুলি জীবনশৈলী ঘটিত সমস্যা।আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ত্রুটি হল রোগগ্রস্ত মানুষের মিছিল আটকানোর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। হার্ট ডিজিজ ও অন্য,জীবনশৈলী ঘটিত সমস্যা থেকে বাঁচানোর জন্য গগনচুম্বী হাসপাতাল তৈরী হলেও এগুলি প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা হয় নি। এই প্রতিরোধের প্রাথমিক পাঠ হওয়া দরকার বিদ্যালয় স্তর থেকে। তারপর আসে রুগ্ন শিশু যারা ভবিষ্যতের নাগরিক। তাদের শৈশব, কৈশোর কাটছে অপুষ্টি ও রক্তাল্পতায়। বড় হয়ে জীবনশৈলী ঘটিত অসুখের প্রাদুর্ভাব তাই বেশি। পরিবেশের দিকে নজর না দেওয়ার জন্য শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট জনিত অসুখ বেড়েছে। বড় শহরে শতকরা ৭০ ভাগ শিশু শ্বাসজনিত সমস্যার শিকার।
এমন নয় যে কোন একটি ব্যবস্থা রাতারাতি তৈরী হয়ে যাবে। স্বাস্থ্য নীতি পরিচালনার দর্শনটি আগে স্থির করতে হবে। গগনচুম্বী অট্টালিকা নাকি গ্রামের মহল্লা ক্লিনিক কোনটা দরকার? প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নাকি যন্ত্রনির্ভর চিকিৎসা, অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নাকি আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা, ওয়েলনেস সেন্টার(wellness centre )না পাবলিক হেলথ সেন্টার। দেশে টীকাকরনের সার্বিক হার কম। প্রতি বছর অন্ততঃ ১৫% শিশুর টীকাকরন হয় না। অনেকে একটা ডোজ নিয়ে বাকিগুলো নেন না। যে দেশে ১৩৭ কোটি মানুষের নাগরিকত্ব পরীক্ষা করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয় সে দেশে হাজার হাজার পরিকল্পিত টিকাকরণ কর্মসূচি শুধু ছুঁচ বা সিরিঞ্জ কিম্বা স্বাস্থ্যকর্মীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা না করার জন্য বাতিল হয়।
স্বাভাবিকভাবেই এইরকম অপ্রস্তুত অবস্থা আমাদের বারোমাস তিনশ পঁয়ষট্টি দিন। করোনার মত মারনব্যাধি আটকানোর মত যেমন আমাদের পরিকাঠামো নেয় তেমনি সঠিক স্বাস্থ্যাভ্যাস ও গড়ে ওঠেনি। যে দেশে নেতারা দূর থেকে ভাষন দিয়ে ভাষণের বিষয়বস্তু ও ভুলে যান সে দেশে সবকিছুই সম্ভব।
সঠিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা তখন সম্ভব যদি আধুনিক শিক্ষার বিস্তার হয়। গত জন গননায় দেখা গেছে যে পরিবারে মা অন্তত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ নিয়েছেন তাদের সন্তান সংখ্যা সীমিত ও তাদের শিশুমৃত্যুর হার কম। কেরালা এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল উদাহরণ। উত্তরপ্রদেশ ও উড়িষ্যার মধ্যে তুলনা করলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হয়। উড়িষ্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধি শূন্যের কাছে। পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুর অবস্থা একরকম। অথচ বিহার ও উত্তরপ্রদেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রথম সারিতে। এই রিপোর্ট থেকে এটাও পরিষ্কার ছোট পরিবারের সাথে শিক্ষা ও আয়ের সাযুজ্য আছে, ধর্ম বা জাতের নয়।
সুতরাং জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির সঠিক রূপায়নে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হল রাজনৈতিক সদিচ্ছা। শিক্ষা সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক হু’ (WHO) এই কথাটি উচ্চারণের পর পাঁচটি দশক অতিবাহিত হয়েছে। এ দেশের জনস্বাস্থ্যের হাল প্রতিবেশি অনেক দেশের তুলনায় খারাপ। শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক মজবুত।
করোনা লক ডাউনে কেউ সরকারি নিষেধের তোয়াক্কা করছে না। তবলীগী মার্কাজের ঘটনা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। একদিকে অশিক্ষিত ধর্মান্ধ মানুষ যে সমাজে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরী করতে পারে তার অনেক উদাহরণ আছে এটি তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আরেক দিকে এই নিয়ে সরাসরি সাম্প্রদায়িক প্রচার এদেশে জনস্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের জ্ঞানের বহর টিও দেখা যাচ্ছে। শাসকদলের নেতা বড় জমায়েত করবেন না বলে নিজেই মিছিল নিয়ে বেরোচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী সপারিষদ পুজো করতে বেরিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতা সদলবলে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারের উপর চড়াও হচ্ছেন। ইন্দোরে ধর্মান্ধ মানুষ ডাক্তারের ঢিল ছুঁড়েছে, মহারাষ্ট্র এই সময় রথযাত্রা আটকাতে গিয়ে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর একটা বড় অংশ হল জনগনকে তার অংশীদার করা ও সঠিক বৈজ্ঞানিক প্রচারের মাধ্যমে তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। সেই কাজটি ভাসন দিয়ে হয় না, সমাজের উচ্চকোটি মানুষকে তার জন্য উদাহরণ তৈরী করতে হয়। সেই কাজটি এদেশে হয় না।
ল্যাটিন আমেরিকার থেকে ভারতের অনেক কিছু শেখার আছে। কিউবা, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলার সংক্রমণ সংখ্যা ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে ও তাদের “response swift, serious and enduring “বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম প্রশংসা করেছে। সিঙ্গাপুর আরেকটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ।অথচ, বল প্রয়োগ করে যে মহামারী ঠেকানো যাবে না তার প্রমাণ ইটালি। শাসকের অননমনীয় মনোভাব ও আন্তর্জাতিক সব নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোর জন্য এই দেশে মৃত্যুহার অতীতের বিউবোনিক প্লেগের যুগের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, তার ফলে সারা পৃথিবীতে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। জনগনকে অংশীদার করে সংক্রমণ কমানো যায় তার উদাহরণ কেরল। সেখানে সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যু বাড়ে নি। কেরালা আরো প্রমাণ করেছে যে মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব, এমনকি 93 বছরের বৃদ্ধাকেও সুস্থ করে বাড়ী পাঠানো গেছে। অবরুদ্ধ মানুষের জন্য যথাযথ অর্থনৈতিক প্যাকেজ দিয়ে আপৎকালীন ব্যবস্থা ও সম্ভব। গালভরা তথ্য নয়, সঠিক প্যাকেজ যেমন পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা বা পাঞ্জাব করে দেখিয়েছে। অন্তঃসারশূন্য তথ্যের ম্যাজিক দিয়ে এই ধরনের যুদ্ধ জেতা যায় না।

জনস্বাস্থ্য অবহেলিত থাকলে দেশ সুস্থ থাকবে না। দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য অভিন্ন, সুষম, আধুনিক ও এক মাণের চিকিৎসা ব্যবস্থা যতদিন না হবে ততদিন এক একটা মারণ ব্যাধি আসবে ও দেশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। দেশের মানুষের সুস্থিতি ও নিরাপত্তার জন্য চাই সব সাম্প্রদায়িক নিয়মের বদলে অভিন্ন আইন, সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বাজেটের বৃদ্ধি ও শ্রীনাথ রেড্ডি রিপোর্টের যথাযথ প্রয়োগ। যে দেশে গণতন্ত্র যত প্রসারিত সে দেশের মানুষ তত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় জনস্বাস্থ্য তত সুন্দরভাবে অনুসরণ করে। আইসল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে ইত্যাদি দেশের জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দর্শন থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। দেশের জন্য শুধু ছাপান্ন ইঞ্চির খাঁচা নয়, ছাপান্ন ইঞ্চির হৃদয় চাই। স্বাস্থ্য বাজেটে জিডিপির অন্ততঃ ৩শতাংশ খরচ করতে পারলে বুকের ছাতি কম হলেও মানুষ বাঁচবে। মানুষ বড় অসহায়, মানুষ কাঁদছে। এখন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে বাঁচানো সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক কর্তব্য।. (ডা. রেজাউল করিম)


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।