চৈতালী নন্দী: চিন্তন নিউজ:৩১শে মার্চ :-সাধারণ ভাবে একটা ধারণা পোষণ করা হয় যে, যখন কোনো সংকট উপস্থিত হয় তখন শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে পুঁজিবাদকে সাময়িক ভাবে পিছনে হটিয়ে সমাজতন্ত্র সামনের সারিতে এগিয়ে আসে। আবার অন্য দিকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সরকারের নির্দেশে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পণ্য উৎপাদনে বাধ্য হয়, যা প্রকৃতপক্ষে জনস্বার্থ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
সাম্প্রতিক মহামারীর প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বা জনস্বাস্থ্য ব্যাবস্থায় সামাজিকীকরণ করা হচ্ছে যা মুক্ত বাজার ব্যাবস্থার ধারণার থেকে অনেকটা আলাদা। যে দেশ সংকটের কবলে যতো বেশী পড়েছে সেই দেশে সামাজিকীকরণ এর মাত্রাও ততো বেশী বিস্তৃত।
বর্তমানে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সংকটের মাত্রার নিরিখে ইটালির পরেই আসে স্পেনের নাম। সেখানে সমস্যার মোকাবিলা করতে বেসরকারি হাসপাতাল গুলিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনা হয়েছে। এই সংকটের অধীনে থাকা দেশগুলি বেসরকারি সংস্থা গুলিকে জরুরি ভিত্তিতে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের নির্দেশ পাঠিয়েছে, যা চীনের পথকেই অনুসরন করেছে। বস্তুত এ হচ্ছে বেসরকারি ক্ষেত্রের উপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি, যা এখন ইউরোপের দেশগুলো এবং মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র করছে।
এই মহামারীর অভিঘাতে আক্রান্ত দেশগুলি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার পিছনে আর একটি কারন হোলো বিজ্ঞান চেতনার উন্মেষ ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা, যা হোলো সমাজতন্ত্রের দিকে একটা বড় পদক্ষেপ। হিন্দুত্ববাদী দের অন্তঃসারশূন্য গোবর বা গোমূত্র ব্যবহারের শিক্ষা যেখানে কাজ করেনা। উল্টে মানুষের চক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ কুসংস্কার পোষণকারী শিক্ষা মানুষের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যার চড়া মূল্য চোকাতে বাধ্য হয় ,তাদের প্রতি বিশ্বাস রাখা আমজনতা, বাড়ে অবিশ্বাস । এই ধাক্কা তাদের নিয়ে যায় সমাজতন্ত্রের দিকে।এই বিজ্ঞান চেতনা, পণ্য উৎপাদন, জনস্বাস্থ্যের সামাজিকীকরণ এই তিনটি বিষয়েই ভারত অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় পিছিয়ে আছে কয়েক কদম। বিপদকালে তাকে মোকাবিলার সঠিক প্রস্তুতির দিকে না গিয়ে সহজে বাজিমাত করার বিপজ্জনক ঝোঁক রয়েছে, যা মানুষকে ধোঁকা দেবার ও বিপন্ন করে তোলার বিকল্প পথ। যেমন ‘জনতা কার্ফু’ করতে গিয়ে মোদি আদতে শেষে মানুষের ক্ষতি করলেন,’সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখা থেকে দূরে সরে গিয়ে। কারণ দলবদ্ধ মানুষ ঘন্টা বাজিয়ে পথে নেমে পড়েছিলেন।
অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতাল গুলিতে সরকারি নির্দেশ সত্বেও, বিনামূল্যে সংক্রমণের পরীক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ নিতে মানুষ ব্যার্থ হয়েছে। এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি ,হিন্দুত্ববাদী সরকার নিজস্বার্থে হিন্দুত্বের কুসংস্কারের প্রভাব কমার ভয়ে বিজ্ঞান চেতনার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে। কারণ মানুষ তাদের বুজরুকি ধরে ফেললে তাদের বিপদ বাড়বে। এদেশে মহামারীর থাবা যতো গভীর হবে, ততোই অন্য দেশগুলোর মতো ভারতও সামাজিকীকরণের পথে যেতে বাধ্য হবে।
অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাহায্য নেওয়ার মতো বিকল্প ব্যাবস্থার প্রবণতাও কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু দেশ এখনও বিভিন্ন ক্ষেত্রে একচ্ছত্র অধিকার ও নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর।একদিকে জনগনের মধ্যে বিশেষ একটা শ্রেণীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে তাদেরকে সব ধরনণের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রবণতা, অন্যদিকে সাধারণ শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষদের সম্পূর্ণভাবে তাদের কপালের উপর ছেড়ে দেওয়া। নিজের দেশে মহামারী র বিপদ সত্বেও মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির তৈরি প্রতিষেধক অসদুপায়ে হস্তগত করার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে ইরানের উপর থেকে জারি করা নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখাতে দাদাগিরি র আশ্রয় নিচ্ছে। এখানেই সেই সব পাওয়া আর কিছু না পাওয়া মানুষের চিরকালীন বিভেদ। মানুষের এই ঘোর দূর্দিনেও মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের সেই বস্তাপচা পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও দখলদারী অব্যাহত, যার বড় প্রমাণ হোলো মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের বিগত নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি র প্রবক্তার পরাজয়, যিনি সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার দাবী করেছিলেন।
তবে এই মহামারীর বৈশিষ্ট্য হোলো একে কোনো ভৌগোলিক সীমানা র মধ্যে বেঁধে রাখা যায়না। যা ট্রাম্প করতে চেয়েছিলেন। তবে একথা বলা হচ্ছে না সংকট মোকাবিলায় পুঁজিবাদ সম্পূর্ণ রূপে বাতিল হবে, কিন্তু যেসব দেশ এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদের সীমানা পেরিয়ে সামনে এগোতে সক্ষম হবে, পরবর্তীকালে তারাই পৃথিবীতে শক্তির কেন্দ্র হিসেবে অবস্থান করবে।এর প্রমাণ দেবে সংকটের স্থায়িত্বকাল।
বর্তমান বিশ্বজোড়া সংকট এই সত্যকে তুলে ধরেছে যে পুঁজিবাদের হাতে এমন কোনো অস্ত্র নেই যা এই বিশ্বায়িত সংকটকে বাজার অর্থনীতি দিয়ে রোধ করতে পারে। এই বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই ভাইরাসের সংক্রমণ, মহামারী দ্রুত বিশ্বজূড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
এর আগে ১৯১৮ সালে স্প্যানিস ফ্লু এর বিশ্বজুড়ে প্রভাব ও বিস্তার যা যুদ্ধের সময় সৈন্যদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ সূত্রপাত একটা জায়গায় হলেও তার প্রভাব পড়ে সারা বিশ্বে। যদিও আগের মহামারী বর্তমান মহামারীর থেকে কয়েকগুণ প্রানঘাতী ছিল। বিশ্বায়নের ফলেই এই ধরণের সংকটকে নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব নয়, যা ট্রাম্প চেয়েছিলেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই চূড়ান্ত ব্যার্থ হয়েছেন।
বর্তমানে এই মহামারী কেন্দ্রীক বিপন্নতা আসলে পুঁজিবাদী ব্যাবস্থারই কালো দিক। এছাড়া এর সঙ্গে সঙ্গে আসছে আরো কয়েকটি সমস্যা। প্রথমতঃ বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দা, যা পুঁজিবাদকে অনেকাংশে ম্লান করে দেয়। এর সমাধান করতে হলে যা করা দরকার ,এই মূহুর্তে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতি তার বিপরীত মুখে হাঁটছে, শুধুমাত্র নিজের দেশের একটা শ্রেণীর উন্নতিসাধনই যার লক্ষ্য। দ্বিতীয়ত, জলবায়ুর পরিবর্তন , যা পুঁজিবাদী ব্যাবস্থারই ফল এবং পুঁজিবাদের কোনো অস্ত্রেই আর একে ঘায়েল করা সম্ভব নয়। তৃতীয় উদাহরণটি হোলো ‘উদ্বাস্তু সংকট’ যা তৈরি হয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পরিস্থিতিতে। যা সৃষ্টি হচ্ছে যুদ্ধ ও শান্তি র প্রক্রিয়ার ফলে।
এই সংকটগুলি চিহ্নিত করেছে প্রচলিত ব্যাবস্থার অবশ্যম্ভাবী পতনকে। এটা শুধুমাত্র একটা পর্ব নয়, বিশ্বজুড়ে মন্দা শুধুমাত্র সাময়িক অর্থনৈতিক নিম্নগামীতা নয়, গোটা ব্যাবস্থার সামগ্রিক চিত্র। যেমন বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়নের কোনো হাতেগরম সমাধান নেই। পু়ঁজিবাদী বিশ্বায়নের যুগেও কিভাবে একটা ভাইরাস বিশ্বজুড়ে বিস্তার লাভ করে সমগ্র মানবজাতি কে আক্রান্ত করেছে, এই মহামারী তা দেখিয়ে দিয়েছে। মানব সভ্যতার এই হঠাৎ উদ্ভূত সমস্যার মোকাবিলায় পুঁজিবাদী ব্যাবস্থা চূড়ান্ত অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হয়েছে। পুরোনো পুঁজিবাদী পথ থেকে সরে এসে, সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলার যে সময় হয়েছে, সাম্প্রতিক ঘটনার বাস্তবতা তা প্রমাণ করে। যদিও আপাতত পুঁজিবাদকে সরিয়ে রেখে জরুরী ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু মনে রাখতে হবে , এটি বাধ্য হয়ে পরিস্থিতির চাপে পড়ে অনিচ্ছুক সিদ্ধান্ত।
তথ্যসূত্র; অর্থনীতিবিদ প্রভাব পট্টনায়েকের একটি নিবন্ধ: