কলমের খোঁচা

স্মরণে হোসে মার্তি


স্বাতী শীল:, চিন্তন নিউজ:১৯ শে মে:- ১৯ শে মে, সমগ্র বিশ্বে একদিকে আজ মহান বিপ্লবী নায়ক হোচিমিন এর জন্মদিন উদযাপিত হচ্ছে,অন্য দিকে কিউবাতে পালিত হচ্ছে হোসে মার্তির মৃত্যু দিবস। হোসে মার্তি কিউবান দেশপ্রেমিক, কবি, সুবক্তা, স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী, দূরদর্শী ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ,সুদক্ষ সাংগঠনিক প্রতিভার অধিকারী, সুলেখক, শিক্ষক,আর ঠিক কি কি বললে যে ওনার যথার্থ পরিচয় প্রকাশ পাবে, তা জানা নেই। আজীবন স্বপ্ন দেখেছিলেন মুক্ত কিউবা- র। কিন্তু তার জীবদ্দশায় তিনি তা দেখে যেতে পারেননি। আজও ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল নাম হোসে মার্তি।

উনিশ শতকের শেষ দিকে বিপ্লবের চেতনা যখন ধীরে ধীরে মানুষের মনে তার ছাপ ফেলতে শুরু করেছে, সেই সময় কিউবার ওপর ছিল স্পেনের আধিপত্য, যা মার্তি মেনে নিতে পারেননি। তিনি বারবার বোঝাতে চেয়েছেন যে কিউবার নিজস্ব স্বাতন্ত্র ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। ১৮৭৩ সালের ১১ ই ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত “স্পেনীয় প্রজাতন্ত্র এবং কিউবার বিপ্লব”নামক পুস্তিকায় তিনি বলেন যে কিউবার মানুষ কখনোই স্পেনের মানুষদের মত থাকতে পারবেন না। তারা অন্য জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। তাদের আনন্দ প্রকাশের রীতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের মধ্যে এমন কোন মৌলিক গুন বা সার্বজনীন লক্ষ্য নেই যা এই দুই জাতিকে একসূত্রে বাঁধতে পারে। কারণ মানুষ একত্রিত হয় ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে।

মার্তি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৩ সালের ২৮ শে জানুয়ারি কিউবার হাভানায়। তাঁর জীবনের প্রথম অংশটি তিনি স্পেনে ই কাটান। তাঁর পিতা মারিয়ানো মার্তি ছিলেন জেলের রক্ষী। অত্যন্ত সৎ পরিবার ছিল মার্তির। তার পিতা-মাতা যদিও অতটা শিক্ষিত ছিলেন না তথাপি তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। মার্তির এই মেধায় আকর্ষিত হয়ে ১৮৬৬ সালে হাভানা ইনস্টিটিউটে তার যাবতীয় উচ্চশিক্ষার ব্যয় ভার বহন করেন তার ছোটবেলাকার প্রিয় শিক্ষক মেনডিভ।

কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক ব্যবহার তাকে খুব কষ্ট দিত। তিনি বারবার বলিষ্ঠ মতামত প্রকাশ করে এসেছেন এর বিরুদ্ধে । এরপর ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে এক স্পেনীয় অফিসারের হাতে একজন কিউবান ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্তির জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে। তিনি এই ঘটনার প্রতিবাদে একটি কবিতা রচনা করেন। তাঁর বন্ধু ফেরমিন ভলদেস দোমিনগেজের সহায়তায় এই কবিতা প্রকাশিত হলে মার্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। বন্ধু দোমিনগেজের বাড়ি তল্লাশি করে মার্তির এক সহপাঠীকে লেখা একটি চিঠি উদ্ধার করে পুলিশ,যাতে স্পেনীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করার জন্য তার বন্ধুকে প্রতারক বলে চিহ্নিত করেছেন মার্তি। এই চিঠিকে সাক্ষ্য প্রমাণ রূপে আদালতে পেশ করা হলে মার্তির ৬ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। জেলে থাকার সময়ে তিনি “স্পেনের রাজনৈতিক কারাগার” নামক গ্রন্থে কারাগার বাস এর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও তিনি তার পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন এবং প্রথমে মাদ্রিদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে জারাগোজা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন, দর্শন ও সাহিত্যে ডিগ্রি অর্জন করেন। খুব কম সময়ের জন্য তিনি ফ্রান্সে ছিলেন তখন তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ “ভালোবাসাই ভালোবাসা দেয়” লেখেন। ১৮৮৭ সালে মার্তি নিজের মধ্য নাম হুলিয়ান ওতার মায়ের বিবাহ পূর্ববর্তী পদবী *পেরেস ব্যবহার করে কিউবায় প্রত্যাবর্তন করেন কিন্তু ততদিনে কিউবার পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করেছে। চাকুরীর চেষ্টা করেও না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি গুয়াতেমালার উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং সেখানে ইতিহাস ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন।এই সময়ে তাঁর প্রচুর লেখা প্রকাশিত হয় যেখানে তিনি দাসত্বের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি বারবার গণতান্ত্রিক সমতার দাবি উত্থাপন করেছেন। তার বলিষ্ঠ লেখনি ক্রমশ জনগণকে প্রভাবিত করতে থাকায় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেন। ১৮৭৮ সালে মার্তি তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী কারমেনের সঙ্গে পুনরায় কিউবায় ফিরে আসেন । কিন্তু তার পরের বছরই অর্থাৎ ১৮৭৯ সালে সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগে তাকে নির্বাসন দেওয়া হলে স্পেনের জেল থেকে পালিয়ে মারতি নিউইয়র্ক এ যান এবং সেখানে চার বছর কাটান।

মার্তি দাসত্বের তীব্র বিরোধিতা করে ও দাসত্ব মোচনে স্পেনের সরকারের অনীহা ও অক্ষমতার তীব্র সমালোচনা করে ১৮৭৯ সালের ২৪ শে জানুয়ারি নিউইয়র্ক এর স্টেক হলে স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার কথা ঘোষণা করেন। ১০ বছরের যুদ্ধের (১৮৬৮ থেকে ১৮৭৮)দেশপ্রেম ও যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করে তিনি জানান যে কিউবারও অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। স্পেন শান্তি চুক্তির শর্ত গুলি কে অনুমোদন করেনি, নির্বাচনের প্রহসন, করের বোঝা বৃদ্ধি, দাসত্ব মোচনে অসফলতা এই সবের থেকে কিউবার মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। মার্তির স্বপ্ন ছিল কিউবাকে একটি গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসেবে দেখার । এর জন্য কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেন এবং এই বিষয়ে ১৮৮২ সালে মাক্সিম গোমেজ কে লেখা একটি চিঠিতে তিনি একটি বিপ্লবী দল তৈরি করার প্রস্তাব দেন। কিউবার হোমরুল পার্টির দিকে ঝুঁকে পড়া কে তিনি ভালো চোখে দেখেননি। কারণ হোমরুল পার্টি ছিল একটি শান্তিকামী দল,যারা কিউবার স্বাধীনতা প্রাপ্তির অদম্য ইচ্ছা কে মূলত খন্ডন করতে চাইছিল। ১৮৮২ সালের ২০শে জুলাই মাসেওকে লেখা আর একটি চিঠিতে তিনি জানান যে,কিউবার যা কিছু সমস্যা তাতে তার রাজনৈতিক সমাধানের থেকে সামাজিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা বেশি,যা দুই জাতির পারস্পরিক প্রীতি ও সৌহার্দ্য ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়।

তিনি নিউইয়র্ক এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র তে নিয়মিত লিখতেন। আমেরিকান নেশনস এ সংবাদ প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করার সূত্রে ও সম্পাদকীয় লেখার সুবাদে তিনি অসংখ্য কিউবান নির্বাসিতের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের সাথে কথা বলে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এই সময়ে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত লেখা “”মন্তেক্রিস্টির ঘোষণা”।১৮৯৪ সালে এই নির্বাসিত মানুষদের নিয়ে তিনি একটি দল গঠন করেন এবং এদের নিয়ে বিপ্লবের উদ্দেশ্যে তিনি কিউবায় ফেরেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার এই অভিযান ব্যর্থ হয় যদিও তার ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৮৯৫ সালে তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সৈন্যবিদ্যাবিশারদ মাক্সিমো গোমেজ এবং আন্তোনিও মাসেও ওই দ্বীপে এসে পৌঁছান এবং পাহাড়ে লুকিয়ে থেকে নির্বাসিত স্বাধীনতাকামী মানুষদের নিয়ে একটি ছোটখাটো সেনাদল প্রস্তুত করেন। বিদ্রোহ সাময়িকভাবে সফল হলেও খুব শীঘ্রই তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এই সময় ১৮৯৫ সালে প্রথম সংঘর্ষে প্রাণ হারান হোসে মার্তি। যদিও তার মৃত্যু বিপ্লব কে থামাতে পারেনি। তবে ১৮৯৮ সালে স্পেনীয়-আমেরিকান যুদ্ধের আগে পর্যন্ত কিউবার ওপর থেকে স্পেনের আধিপত্য কমানো যায়নি।শেষ পর্যন্ত ১৯০২ সালে মার্তির আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণ ঘটে।আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কিউবা কে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করে এবং কিউবার নিজস্ব সরকার গঠিত হয়।

মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে মার্তির ধ্যান জ্ঞান একমাত্র লক্ষ্য ছিল কিউবার স্বাধীনতা, কিউবায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, তার বলিষ্ঠ লেখনি, তার উদ্দীপক বাগ্মীতা দ্বারা হোসে মার্তি প্রমাণ করেন যে, তরবারির চেয়ে কলমের শক্তি অনেক বেশি। আজও হাভানার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি তার নামেই নামাঙ্কিত। কিউবার স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রথম নায়ক হোসে মার্তি আজও কিউবার মানুষের হৃদয়ে, তাঁদের ভালবাসায় বেঁচে আছেন।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।