দেশ

শ্রমিক শোষণ পুঁজির তোষণ ; ভারতের শ্রমনীতি।।


চৈতালি নন্দী: চিন্তন নিউজ:১২ই মে :–করোনা প্রসুত লকডাউনে বিশ্বজোড়া অর্থনীতির মন্দার অভিঘাতে ছিন্নভিন্ন শ্রমিক সুরক্ষা। এই মন্দার মোকাবিলায় অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন‍্যে বিভিন্ন দেশ শ্রমিক ছাঁটাই রোধ করে তাদের যতোটা সম্ভব সামাজিক সুরক্ষা দিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ভারত ও আমেরিকা হাঁটছে সম্পূর্ণ উল্টো পথে। সম্প্রতি আইএলও সনদ ভেঙে ভারত শ্রমিক বিরোধী যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশের’ মিথ‍্যাচার মানুষের সামনে পরিষ্কার। নতুন যে শ্রমনীতি আনা হয়েছে তাতে বেপরোয়া শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রমিক দের সামাজিক সুরক্ষা হ্রাস সহ অমানবিক শ্রমিক বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।প্রতিনিয়ত কাজ হারানোর অনিশ্চয়তা শ্রমিকদের মনোবলে চরম আঘাত হানছে। অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন মনে করেন, অর্থনীতির পুনর্গঠনে শ্রম আইন কে অস্বীকার করে, অবাধ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের যে পদক্ষেপ কেন্দ্র নিচ্ছে তাতে অর্থনীতির সংকট আরও বাড়বে। শ্রমিক সংগঠন সিটু জানিয়েছে, শ্রমআইনকে শিকেয় তুলে শ্রমিকদের কার্যতঃ দাস হিসেবে ব‍্যাবহার করতে চাইছে সরকার। এই শ্রমনীতি অবিলম্বে বাতিলের দাবী জানিয়েছে তারা।

প্রকৃতপক্ষে কর্পোরেট হাউসগুলোর একতরফা পরামর্শে দেশের শিল্প পুনর্গঠনে দেশ থেকে শ্রম আইন তুলে দেওয়া, ছাঁটাই, কর্মসময় বাড়ানো সহ একগুচ্ছ পরামর্শ বিজেপি শাসিত রাজ‍্যের সরকারগুলি ইতিমধ্যে ই কার্যকর করতে চলেছে। অর্থনৈতিক মন্দাবিদ্ধস্ত বিশ্বে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো যখন সবচেয়ে দরকার ছিল, এদেশে সেই কঠিন সময়েই তুলে দেওয়া হচ্ছে শ্রমিক সুরক্ষার শ্রম আইনটি। শিল্পে বিনিয়োগ, ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অজুহাতে শ্রমিকদের কাজের সময় ৮ ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ঘন্টা করা হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন(আইএলও) এর প্রস্তাবকে লঙ্ঘন করছে, যা মানতে ভারত সরকার চুক্তিবদ্ধ ছিল।
কর্পোরেট হাউসগুলোর অপপ্রচার ছিল, শ্রম আইন শিল্প বিনিয়োগে অন্তরায় হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যেখানেই শ্রম আইন শিথিল করা হয়েছে সেখানে বিনিয়োগ তো বাড়েইনি বরং দূর্দশা বেড়েছে শ্রমিকদের। এই সুযোগে শিল্পেবিনিয়োগ বাড়ানোর অজুহাতে ২০১৯ সালে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা কর্পোরেট হাউসগুলো নজিরবিহীন ভাবে মকুব করে নিয়েছিল।

বিভিন্ন দেশ যখন অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে বাঁচতে শিল্পে ভর্তুকির ব‍্যাবস্থা করছে, সেখানে মোদি সরকার অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের নামে সব রকমের ক্ষতির বোঝা চাপিয়ে চলেছে শ্রমিকদের কাঁধে, যা আক্ষরিক অর্থে শ্রমিকদের গলার ফাঁস হয়ে বসতে চলেছে। অর্থনীতির এই চরম দূর্দশার সময়ে শ্রমিকদের পাশে না থেকে কর্পোরেটদের পাশে দাঁড়িয়ে একের পর এর শ্রমিক বিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার শ্রমিকদের ক্রীতদাসে পরিণত করতে চাইছে। পুরোনো শ্রমআইনকে যদি পরিবর্তন করতেই হয়, তবে তাতে ভারসাম্য থাকা খুবই প্রয়োজন, যাতে শ্রমিকরা বঞ্চিত না হয়। কার্যতঃ শিল্প চাঙ্গা করার অজুহাতে শ্রম আইন তুলে দেবার চক্রান্ত গত একবছর ধরেই নেওয়া হচ্ছিল, যা এই লকডাউনের সুযোগে কার্যকর করা হোলো।
কেন্দ্রীয় ও রাজ‍্যের শ্রম আইনগুলির বিলোপ ঘটিয়ে চারটি শ্রমকোড তৈরির পরিকল্পনা হয়। তারমধ‍্যে মজুরির শ্রমকোডটি ইতিমধ্যেই পাশ হয়েছে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ইউটিইউসি এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। এই লকডাউন এর সময়কালেই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির অভিমুখ স্পষ্ট বোঝা গেছে বিভিন্ন সরকারি সিদ্ধান্তের মধ‍্যেই। অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ বলে পরিচিত এই সহায় সম্বলহীন, অনাহারক্লিষ্ট পরিযায়ী শ্রমিকরা যেভাবে দলবদ্ধ পশুর মতো মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে নিজরাজ‍্যের অভিমুখে যাত্রা করেছেন এবং পথেই বহু শ্রমিকের প্রাণ গেছে, তাতে প্রমাণ হয় এই সরকার শুধুমাত্রই পুঁজিপতিদের সরকার, শ্রমিকদের সরকার নয়।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।