কলমের খোঁচা

ভারতের প্রাচীন মুদ্রা ও তার ব্যবহার


সূপর্ণা রায়:চিন্তন নিউজ:৪ঠা মার্চ:–কড়ি দিয়ে কিনলামএটি একটি প্রাচীন প্রবাদ“”ফেলো কড়ি মাখো তেল””নগদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।খিষ্ট্রজন্মের চার পাঁচশো বছর আগে থেকেই বাংলাদেশ এ মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়েছিল।। প্রাচীন মুদ্রা দিনার,রূপক,দ্রক্ষ,কপর্দক পুরান ইত্যাদির মতো কড়িও ছিল একসময় বাংলার মুদ্রা।লক্ষন সেনের আমলে কৌড়ি কড়ির প্রচলন ছিল। ঐতিহাসিক মীরহাজুদ্দিন লেখা ইতিহাস গ্রন্থ এ আছে যে লক্ষন সেন কাউকে দান করার সময় লক্ষ কড়ির কম দিয়েন না।।এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, কড়ির আকারে নির্মিত রৌপ্যমুদ্রা কে বলা হতো কপর্দক।পুরানে কিন্তু তার কোন নমুনা পাওয়া যায় নি।।তাই অনেকের ধারণা কপর্দক বলতে বোঝাত কিছু সংখ্যক কড়ি।।

একসময় ভারতে ভূমি রাজস্ব রৌপ্যমুদ্রায় ধার্য হতো।বাঙলায় গুপ্ত যুগে স্বর্ন ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিল।।গুপ্ত যুগের পরেও বাংলার রাজারা স্বর্ন মুদ্রার প্রচলন রেখেছিলেন।। কিন্তু সেসব স্বর্ণমুদ্রা ছিল অতি নিকৃষ্ট ধরনের।।তারপর রৌপ্যমুদ্রার অভাব দেখা দেওয়ায় বাংলা ও বিহার এ কড়ির প্রচলন শুরু হয়।। গুপ্ত আমলে মুদ্রার নিম্নতম মান ছিল কড়ি।। ফাহিয়েন মতে চতুর্থ শতকে কড়ি দিয়েই ক্রয় বিক্রয় হতো।। ত্রয়োদশ শতকেও কড়ির প্রচলন ছিল পঞ্চদশ শতকে কড়ির প্রচলন এর প্রমাণ পাওয়া যায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এবং বিদেশি পর্যটকদের বিবরণে।”বেহাইর পায়ে পড়ি/ব্যাবহার কৈল কড়ি—–( কবিকঙ্কন চন্ডী)…. প্রাচীন কালে কাশ্মীরে ও ক্রয় বিক্রয় হতো কড়ির মাধ্যমে।

স্টেইন সাহেবের মতে দিন্নার আসলে কড়ি ছাড়া আর কিছু নয়।। কাশ্মীরে একশত কড়িকে বলা হতো “হত”… সেসময় একশোটি কড়ির বিনিময়ে একটি তাম্রমুদ্রা পাওয়া যেত।এক খারি ধানের মূল্য ছিল ২০০ কড়ি ।এক খারি সমান ৮৪ কিলোগ্রাম। একাদশ শতাব্দীতে কাশ্মীর এর রাজা অনন্ত শাহ ঘড়া ঘড়া কড়ি রাখতেন। প্রাচীন কালে কোথা থেকে কড়ি আসত জানা না গেলেও মধ্যযুগের শেষ ভাগে ভারতে আমদানি হতো মালদ্বীপ থেকে।। মালদ্বীপের ৩২০০ কড়ির মূল্য ছিল এখনকার ৩৫ পয়সা।। মালদ্বীপের কড়ি পশ্চিম ভারত এর সুরত বন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসত।।

১৭৫০ সালে খোদ ইংরেজরা খোদ কলকাতায় কড়ির মাধ্যমে কর আদায় হতে দেখেছিল।। বাজারে কেনাকাটা করতে হত কড়ির মাধ্যমে।। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই কড়ির প্রচলন সমগ্র বঙ্গদেশে ছিল।। অষ্টাদশ শতাব্দীতে হুগলি জেলার কড়ি দিয়ে কর আদায় হত।। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ এ কড়ির প্রচলন ছিল।। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিলেতেও কড়ির চাহিদা ছিল।।১৭৭৫ সালে ৪ সেপ্টেম্বর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রস্তাব ছিলসারা বছর যে সকল কড়ি রাজস্ব হিসেবে আদায় হবে তা প্রতি মাসে থলিতে ভরেএক্সপোর্ট ওয়্যার হাউস এর রক্ষক এর কাছে পাঠাতে হবে।।তারপর সেগুলো জাহাজে করে ইংল্যান্ড এ পাঠানো হতো।।

আজকের দিনে ছেলে দের নামকরণ আর টাকা-পয়সা দিয়ে হয় না ঠিকই, কিন্তু এককালে অর্থ প্রীতির বশেই ছেলে দের নামকরণ করা হতোতিনকড়ি, পাঁচ কড়ি,সাত কড়ি ইত্যাদি।। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ও এই কড়ি দিয়ে নামকরণ বেশ প্রচলিত ছিল।। বাংলায় কড়ি সন্মন্ধে কিছু শব্দ আছে যেগুলো কড়ি মুদ্রার প্রমাণ দেয় যেমন ১)কড়িওয়ালাধনবান ২)কড়িকপালে ভাগ্যবান ৩)কড়ি চন্ডালঅর্থপিশাচ ৪)কড়ি প্রত্যাশি অর্থলোভী ৫) কড়িয়াল ধনী ৬)কড়ে অর্থশালী ৭) কড়েল_ধনী ইত্যাদি।।। বাংলাদেশ এ যে একাকালে কড়ি মুদ্রার যথেষ্ট পরিমাণে প্রচলন ছিল এই শব্দ গুলো তার সাক্ষী বহন করে চলেছে।।।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।