কলমের খোঁচা

কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও বর্তমান ধর্মীয় বিদ্বেষে কবির প্রাসঙ্গিকতা :-


মধুমিতা রায় : চিন্তন নিউজ:২৬শে মে:– কবি কাজী নজরুল ইসলাম যাকে ঘিরে বাঙালি ও বাংলার আবেগ আজও একসূত্রে গাঁথা। যার রচনা কোনো জাতি, ধর্ম ,বর্ণের দ্বারা প্রভাবিত ছিলনা। তাই তিনি লিখেছেন … “যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান / যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রীষ্টান ।” কবির কলম আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক।

কবি নজরুল সাম্যবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ কবি, মানবতার, মুক্তির জন্য তাঁর লেখনী অমর । কবিকে বিংশ শতকে “যুগের কবি ” নামে আখ্যায়িত করা হলেও তাঁর রচনা যুগের দাবীকে ছাড়িয়ে মানুষের চিরন্তন সমস্যাকে নিয়েও । মানব ইতিহাসে কবির কলম শাশ্বত, নশ্বর । তাই তিনি “চিরকালীন কবি”। বর্ধমানের এক অখ্যাত গ্ৰামে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠার কারণে তৎকালীন গ্রাম্য ,অশিক্ষার পরিবেশে ধর্মীয় ভাবাবেগ ও কুসংস্কার থাকলেও তার চিন্তা চেতনায় হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলনা। কেবলমাত্র পরাধীনতার শৃঙ্খল ও গ্রাম -শহরের বিশাল বৈষম্য দ্বারা প্রভাবিত ছিল। কলকাতার শহরতলীতে এসে কবি উপলব্ধি করেন ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মৌলবাদী শক্তির শিকড় ছড়ানো হিন্দু মুসলিম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মানবমুক্তির পথে যা অন্তরায়। একশো বছর পূর্বেও যে ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপদের গন্ধ তিনি টের পেয়েছিলেন আজোও তার শিকার আমাদের সমাজ । কবির স্বপ্ন ছিল সাম্যবাদী , কুসংস্কার মুক্ত এক সমাজ। তাই কবির কলম গর্জে উঠেছিল তৎকালীন ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে।

প্রাক স্বাধীনতার যুগেও কবি ধর্মীয় উন্মাদনাকে তাঁর রচনা দিয়ে যে ভাষায় আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলেন তা একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও প্রায় অসম্ভব। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কবির আশঙ্কা আজকের দিনেও বর্তমান। বরং সাথে যুক্ত হয়েছে জঙ্গিবাদ । সেদিনের যা কুসংস্কার যুক্ত মৌলবাদী শক্তি ছিল তা জঙ্গিবাদের উত্থানে এই শক্তির তীব্রতা কে বৃদ্ধি করেছে। কবির স্বপ্ন ছিল প্রথাগত ঘূণধরা সমাজের বাইরে গিয়ে নুতন আলোকিত সমাজ গঠন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মানুষের মুক্তির পথে বড়ো বাধা মৌলবাদ। তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে এই বার্তা দিতে চেয়ে লিখেছিলেন ..
“ আশিটা বছর কেটে গেল আমি ডাকিনি তোমায় কভু /
আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করেনি প্রভু !/
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী/
মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী !” (মানুষ)
এই কবিতার মধ্য দিয়ে কবির মৌলবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সত্ত্বারই প্রকাশ পায় । কবির আদর্শ অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তার অবিচল নিষ্ঠা আজকের দিনেও আমাদের প্রজন্মের কাছে প্রেরণার জোগান দেয় ।তাঁর লেখনী ধর্মের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনতার জন্য লড়াইয়ের উৎস । তিনি তাঁর রচনার মাধ্যমে মৌলবাদী শক্তিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে লিখেছিলেন “ মন্দির আর মসজিদ ওই শয়তানদের মন্ত্রনাগার । ” কবিকে উগ্র জাত্যাভিমান প্রভাবিত করতে পারেনি। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবদেবীদের নিয়ে যেমন গান রচনা করেছিলেন তেমনই মুসলিম আদর্শ ও ঐতিহ্য কেও সবার সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। সাম্প্রদায়িক হানাহানির সময় যখন সমাজ রক্তাক্ত তখনও তিনি লিখেছিলেন “ অবতার- পয়গম্বর কেউ বলেনি , আমি হিন্দুর জন্য এসেছি , আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি । তারা বলেছেন , আমরা মানুষের জন্য এসেছি — আলোর মতো, সকলের জন্য।” তিনি তাঁর কলমকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করার কাজে লাগিয়েছিলেন , তাই লিখেছিলেন “ হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন ?” তার এই লেখা বিংশ শতকে সম্প্রীতির বার্তা হিসেবে কাজ করেছিল । তাঁর রচনা “ হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ ” , “পথের দিশা ” এসব কবিতা দেশবাসীকে একতার সূত্রে বাঁধতে সাহায্য করেছিল।
আজ থেকে প্রায় একশো বছর পূর্বে কবি যে ভাষায় তাঁর লেখনী কে শানিত করেছিলেন ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে তা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের সমাজ দেশ উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ভাবধারায় ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্ৰস্ত । আজ আমাদের রাস্ট্র সন্ত্রাসবাদের কাছে পদানত । প্রতিমুহুর্তে আক্রান্ত মানবতার মুক্তির সেবায় নিয়োজিত মানুষ জন। এই রকম এক কঠিন সময়ে আমাদের শিক্ষিত সমাজের মানুষের বড়ো বেশি বেশি করে কবি নজরুলের রচনা চর্চার প্রয়োজন। কবির লেখায় পারবে বর্তমান ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে কলুষমুক্ত করতে । ধর্ম আর বিভেদের রাজনীতির বিষ ছড়িয়ে যারা সমাজকে আরো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে কবির কলম আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক …
“ ভেদ বিভেদের কথা বলে যারা , তারা শয়তানী চেলা /
আর বেশি দিন নাই , শেষ হয়ে এসেছে তাদের খেলা ।” /(নজরুল) .. তাই আজ কবি নজরুলের জন্ম দিবসে কবির রচনা চর্চার প্রয়োজন আরো বেশি করে । বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে নজরুলের জীবন দর্শন থেকে রচনা চর্চা সমাজের সাম্প্রদায়িক দিকের অমানিশা কাটিয়ে আলোর দিশারীর সন্ধান দেবে। কবির রচনা তাই মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আজকের দিনেও সমান প্রাসঙ্গিক ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।