চৈতালী নন্দী, চিন্তন নিউজ, ২ অক্টোবর: গান্ধীজির মত ও পথ নিয়ে বিতর্কের শুরু তার জীবৎকাল থেকেই। বিভেদের মধ্যে ঐক্যের যে ভারতীয় সংস্কৃতি, তাকে তিনি একত্রিত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে। একবিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন দেশ যখন উগ্র জাতীয়তাবাদী ও কর্তৃত্বকামী রাষ্ট্র ক্ষমতার দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন গান্ধীজির রাজনৈতিক দর্শন ও গন আন্দোলনের পুনর্মূল্যায়ন প্রাসঙ্গিক।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই স্বাধীন ভারতের বৈশিষ্ট্য কি হবে তা নিয়ে কয়েকটি চিন্তাস্রোতের সৃষ্টি হয়। কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বাধীন ভারত ধর্ম নিরপেক্ষ, গনতান্ত্রিক, সাধারনতন্ত্র হবে। বামপন্থীরা এর সঙ্গে সহমত হয়েও মনে করতো রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে প্রতিটি মানুষের আর্থ-সামাজিক স্বাধীনতায় প্রসারিত করতে হবে, যা সমাজতন্ত্র স্থাপন ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। অপরদিকে মুসলিম লিগ এবং আরএসএস মনে করতো যে স্বাধীন ভারতের চরিত্র নির্ধারিত হবে মানুষের ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে। এই তিন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রামের পরিনতির উপরেই ভারত ধারনার ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল।
কংগ্রেসের রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে গান্ধীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি ‘নেশন’-এর একটি সভ্যতা ভিত্তিক বৃহত্তর সামুদায়িক সংজ্ঞার উপস্থাপন করলেন, যার ভিত্তি ভারতীয় সভ্যতা। তাঁর চিন্তায় ‘দেশ’ বা’জাতি’ র মূল ভিত্তি হলো মানুষ, শুধুমাত্র ভৌগোলিক অঞ্চল নয়।তাঁর এই সভ্যতা ভিত্তিক সংজ্ঞা পশ্চিমী সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ থেকে ভিন্ন এবং অনেক বেশী মানবিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক।
গান্ধীজী পশ্চিমী গনতন্ত্রে খুব আস্থাশীল ছিলেন না। তিনি মনে করতেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের শ্রেনীস্বার্থ ও দলীয় রাজনীতির বাইরে সাধারণ মানুষের কথা ভাবেনা। তাঁর অহিংস আইন অমান্য আন্দোলন ছিল নির্বাচন ও প্রাতিষ্ঠানিক গনতন্ত্রের পাশাপাশি একটি পরিসর; যার প্রয়োজন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। এক অর্থে গান্ধীজী ছিলেন অনৈতিক শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের নৈতিক প্রতিরোধের ধারণা।
একটি প্রতিক্রীয়াশীল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও গান্ধীজী আধুনিক জাতীয় গনতান্ত্রিক আন্দোলনে বিপুল দরিদ্র অংশকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইএমএস-এর মতে এই স্ববিরোধিতা আমাদের দেশের প্রকৃত রাজনৈতিক জীবনের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। গান্ধীজী যেমন জনসমষ্টির বৃহৎ অংশকে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে সামিল করেন, তেমনই বুর্জোয়া শোষনকে বিপন্ন করে সেই পর্যায়ের জঙ্গি আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করেন (চৌরিচৌরা, আমেদাবাদ ইত্যাদি)। তাঁর এই ক্ষমতা স্বাধীন ভারতের উদীয়মান শাসককুলের শ্রেণী শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।
স্বাধীনতার পর গান্ধীজী তাঁর মূল্যবোধে অনড় রইলেন। কিন্তু নয়া শাসককুল সাম্প্রদায়িক ঐক্য সহ গন-উন্নয়নের প্রশ্নে তাঁর অবস্থানকে নস্যাৎ করতে দ্বিধাবোধ করেনি। ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির আক্রমণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষ গনতান্ত্রিক সাধারনতন্ত্রকে রক্ষার প্রত্যয় নির্মানে গান্ধীজী ও তিনি যে মূল্যবোধের (ধারনা) পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিছু সীমাবদ্ধতা সত্বেও, তার সঠিক চর্চা আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।