মল্লিকা গাঙ্গুলী, চিন্তন নিউজ, কোলকাতা, ১ এপ্রিল: মহানগরীর প্রেস ক্লাবের সামনে মেয়ো রোড। ২৮শে ফেব্রুয়ারি। দিনটা বাংলার ইতিহাসে কালো অক্ষরে লেখা দিন! একদল তাজা ঝকঝকে তরুণ তরুণী যাদের চোখে মুখে ভাবী শিক্ষকের অদম্য আগ্রহ আর ব্যাগ বন্দী উচ্চ শিক্ষার তকমা- SSC পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও সরকারের বঞ্চনার প্রতিবাদে গত 28শে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করলো বর্তমান শাসকের প্রতি তীব্র প্রতিবাদী অনশন!!
এরা কারা? ২০১১ সরকারে এসে তৃণমূল শাসক ২০১২ সালে প্রথম এবং শেষ বারের মতো SSC পরীক্ষার নাটকটা করে এই ২০১৯ এও সফল প্রার্থীদের চাকরি দেয় নি তারা।
৩রা মার্চ: ঠান্ডা ঘর থেকে শিক্ষামন্ত্রী ভাবলেন মেরুদণ্ডহীন বঙ্গসন্তান কি আর করবে? তিনি মৌখিক ভাবে অনশন তুলে নিতে বললেন। কিন্তু ছেলেমেয়েদের তখন জেদ চেপে গেছে, আটজন অসুস্থ হলেও তারা জানিয়ে দিল লিখিত আশ্বাস ছাড়া অনশন তুলবে না! এই দিনই কমঃ সুজন চক্রবর্তী শিক্ষামন্ত্রী কে অনুরোধ করলেন, অনশনকারীদের যে ন্যায্য দাবী, মেধাতালিকা স্বচছ করে অনলাইনে প্রকাশ করা হোক।
পেরিয়ে গেল আরও একটা দিন। ৫ই মার্চ: একে একে অসুস্থ সংখ্যা বাড়ছে আর আন্দোলনকারী দের জেদ তীব্রতর হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়েছে দাবানলের মত তার ক্ষোভের আগুন। আশ্বাস দিতে এলেন dyfi রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র, সভানেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি সহ আরও অনেকে।
৭ই মার্চ: ssc উত্তীর্ণদের পাশে কমরেড মহঃ সেলিম, প্রশ্ন তুললেন নিয়োগের আগে কমিশন যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল সেই নিয়ম কেন ভাঙা হলো?? কেন মেধা তালিকায় পিছনে থাকা প্রার্থী নিয়োগ হয়ে গেল? তিনি বলেন সাতদিন ধরে খোলা আকাশের নীচে অনশনে বসে যুবশক্তি, এই ঘটনায় অন্য যে কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছুটে আসতেন!
৮ই মার্চ?আন্তজার্তিক নারী দিবসের মিছিলে হাঁটছেন আমাদের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী যার অদূরে প্রখর রোদে অনশনে ক্লিষ্ট বহু নারী, সে দিকে তাঁর ভ্রূক্ষেপ নাই! তাদের ফেস্টুনে লেখা- “আজকে নাকি নারী দিবস শুনছি সবার মুখে, নারীরা কি সত্যি আজো আজে মহা সুখে!!”
৯ই মার্চ: টানা দশ দিন! শিশু সন্তান কে সঙ্গে নিয়েই মা খোলা রাস্তায় পথে, সরকারের কোন মানবিক পদক্ষেপ নেই দেখে ক্ষুব্ধ বিশিষ্ট জনেরা, এই বঞ্চনার অবসানে রাজ্যপালের হস্তক্ষেপের জন্য স্বাক্ষর করলেন সেভ ফোরামের আহ্বায়ক আনন্দ দেব মুখোপাধ্যায়, অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ, প্রতিচী ট্রাস্টের কুমার রানা, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন সভাপতি মঞ্জু গোপাল মুখোপাধ্যায় সহ বহু অধ্যাপক।
১১মার্চ; অনশনের বারোতম দিন, শিক্ষা ও সমাজের সবথেকে মর্মান্তিক কালো দিন!! অসুস্থ ৪৬ তবু নীরব সরকার। আর চাকরি প্রার্থী অনিতা দাস যে দুমাসের গর্ভাবস্থায় অনশন শুরু করেছিলেন, সেই মা হারালেন তার অন্তস্থঃ ভ্রূণ! ?টানা অনশনে আদরের ধন, হারায়েছে মাগো , হয়নি নব জাতক! বড়ো অভিমানে ভ্রূণ বলে গেছে, এখানে শাসক নিজেই নরখাদক!! সান্তনা দিতে উপস্থিত কমঃ সুজন চক্রবর্তী অম্বীকেশ মহাপাত্র সায়নদীপ মিত্র প্রমুখ সচেতন সহানুভূতিশীল মানুষ।
১৩মার্চ: নীরব সরকারের উদাসীনতায় অসুস্থ আরও.. চাকরি প্রার্থীদের অনশনে সামিল তাদের পরিবারবর্গ। ১৪মার্চ: অসুস্থের সংখ্যা ৫০, আন্দোলনকারী দের হয়ে রাজভবন গেলেন গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, পঃ বঃ মহিলা সমিতি, নিখিল বঙ্গ মহিলাসমিতির নেত্রীবৃন্দ।
১৫ই মার্চ: ১২থেকে ১৯ সাত বছরে সাতবার যে কমিশনের চাকরি নিয়োগ করার কথা, তা থমকে আর তার প্রতিবাদে যুব সমাজ যে চরম পথ বেছে নিল তা শুধু তাদের নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াই নয়, এ লড়াই আক্রান্ত শিক্ষা ব্যবস্থা কে বাঁচানোর লড়াই। বললেন মালিনী ভট্টাচার্য। ‘তারা পথে নয় স্কুলে যেতে চায়’ ।
১৬মার্চ: অনশনরত দের পাশে কবি শঙ্খ ঘোষ, বিচারক অশোক গাঙ্গুলী সহ বিশিষ্ট জনেরা।
১৭ই মার্চ: চাকরি প্রার্থীদের সমর্থন করল বামফ্রন্ট। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু তীক্ষ্ম ভাষায় বললেন, বাজারি মিডিয়া কোন প্রার্থী কি খেয়ে প্রচারে যাচ্ছেন তাই নিয়ে ব্যস্ত আর এত গুলো দিন কিছু না খেয়ে ঝড়েজলে কষ্ট করে এতগুলো প্রাণ অসুস্থ তাদের দেখতে পায় না! অবিলম্বে সরকারের উচিত তাদের ন্যায্য দাবী মেনে নেওয়া।
১৯ মার্চ : অনশনকারীদের পাশে বামপ্রার্থী নন্দিনী মুখার্জি থেকে পবিত্র সরকার, রজত মুখার্জি সহ বহু লেখক শিল্পী।
২২মার্চ: প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করেও অনড় ssc উত্তীর্ণরা। টানা ২৩ দিনের অনাহারে শয্যাশায়ি ৭৩ আর তখন শিক্ষা মন্ত্রীর ব্যঙ্গ; অনেকে এরকম জলে ভেজে!! এমন কি প্রশ্ন তোলেন এদের সবাই কি শিক্ষকতা সুযোগ পাওয়ার যোগ্য??? আর ঠিক তার পাশেই আশা প্রদীপ হাতে নিয়ে তরুন কবি মন্দাক্রান্তা সেন, তার শানিত তীব্র বক্তব্য আর বলিষ্ঠ লেখনী অনশন মঞ্চে নতুন প্রাণসঞ্চার!!
২৩ মার্চ: আব্রুহীন রাস্তায় যেন এক উদ্বাস্তু শিবির, অদম্য তেজের ২৪রাত! বন্ধ সুলভ শৌচালয়ের দরজা! মনে করিয়ে দেয় রোহিঙ্গা শিবির বা পঞ্চাশের দশকের শিয়ালদহ স্টেশনের শরণার্থী শিবির!
২৫মার্চ: ওপর তলার নির্দেশে খুলে নেওয়া হলো মাথার পলিথিন। অনশনের ২৬ দিনে চৈত্রের চড়া রোদে অভুক্ত মৃতপ্রায় ছেলেমেয়ে গুলো র পাশে একমাত্র সান্তনা মননশীল কিছু মানুষ। আর এই দিনই চাকরি প্রার্থী শক্তিপদ মাইতির বাবা সুবল মাইতি ছেলেকে আন্দোলনে পাঠিয়ে নিজেই পৃথিবী ছাড়লেন, তার দেখা হলো না ছেলের চাকরি পেয়ে সংসারের হাল ফেরানো! ২৬মার্চ: বিহানীর মা তিনদিনের সদ্যজাত কে রেখে যে চাকরি পরীক্ষা টা দিয়ে পাশ করেছিল সেই ছোট্ট বিহানী আজ হাসপাতালে জেনেও মা ২৭দিন অনশনে রাস্তায়। “ফুটপাতে ২৭দিন, বুকেতে ঝঞ্ঝা অবিরত, পেটের ক্ষিদেটা জানে দ্রোহো; চেতনা এখনও জাগ্রত!!” ২৭মার্চ: অনশনের আঠাশতম দিনে তিনি এলেন জয় করলেন চলে গেলেন! অনশন মঞ্চে মমতা! বুকে দলের ব্যাজ লাগিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে অনশন তুলে নিতে বললেন, তবু অনশন উঠলো না!! অবশেষে পুলিশের প্রচন্ড চাপের মুখে অনশন মঞ্চে বিকেল 4টা -5টা আন্দোলন কারীদের প্রেসকনফারেন্স হলো।
*দীর্ঘ ২৯দিনের অস্তাচলের রক্তিম সন্ধ্যায় অনশনকারীরা জানালো তারা মুখ্যমন্ত্রী কে সম্মান জানিয়ে সাময়িক ভাবে অনশন তুলে নিচ্ছেন এবং জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সমস্যা-র সমাধান না হলে আবার আমরা আমরণ অনশনে বসবেন।
তারা জানালেন, “কবি শঙ্খ ঘোষ এবং বিশিষ্ট জনেদের অনুরোধে এই অনশন প্রত্যাহার করলাম”। রাজ্যবাসী চেতন মানুষ সাময়িক স্বস্তি পেলেন।। কি উত্তেজনা! প্রথমে যুদ্ধ যুদ্ধ বাদ্য ,সীমান্ত থেকে সারা দেশ সেই বাদ্যির ঝাঁঝ ধরে এল ভোটের বাদ্যি, কিন্তু এই বাদ্যের কাড়ানাকাড়ায় দিব্যি চাপা পড়ে যায় ৪৫০জন সফল চাকরি প্রার্থীর অভাবনীয় অনশনের জেদ! তাদের পেটের নাড়িভুঁড়ি গুলো শুকিয়ে পাথর; ভোটের দামামা বাজছে, কড়কড়ে টাকা উড়ছে, অথচ রাজ্যের ভবিষ্যত এই যুবশক্তির প্রতি শাসক উদাসীন!