চিন্তন নিউজ:১৫ই মে:- আমাদের ক্যালেন্ডারে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিন বিশেষভাবে চিহ্নিত করা থাকে, যেগুলিকে আমরা প্রতি বছর নির্দিষ্ট দিনে বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব সহকারে স্মরণ করি বা পালন করি। চলতি বছরের ১২ ই মে আর ১৩ ই মে এমনই দুটো বিশেষ দিন, যা তাৎপর্য্যমন্ডিত স্মরণীয় দিন হিসাবে এবার আমাদের ক্যালেন্ডারে সংযুক্ত হবে। প্রথমটা অর্থাৎ ১২ ই মে সারা দেশে এবং দ্বিতীয় দিনটি অর্থাৎ ১৩ ই মে এই রাজ্যে এবার থেকে আমরা ফি বছর স্বাড়ম্বরে পালন করতে থাকবো। কেন ? তাৎপর্য্যমন্ডিত কেন ? প্রথমে ধরা যাক ১২ই মে – এদিন ভারতবর্ষের অবাধ্য মাটিকে স্বপারিষদ যথেষ্ঠ যত্ন ও নিষ্ঠা সহকারে কর্ষণ করে একশ, হ্যাঁ একশ শতাংশই প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (FDI) অতি উর্বর জমিতে রূপান্তরিত করার মহান ও অদ্বিতীয় রূপকার,“মেক ইন ইন্ডিয়ার” Innovator ধ্যান ভঙ্গ করে আবির্ভূত হলেন নতুন অবতারে “আত্মনির্ভরতার” Torchbearer রূপে ‘গ্লোবালে’ নয় ‘লোকালে’ ভরসা রাখার অনির্বচনীয় বাণী নিয়ে, সঙ্গে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় করোনা-বিপন্ন দেশবাসীর জন্যে ২০লক্ষ কোটি টাকার“বিশেষ প্যাকেজ” । এবার আসা যাক ১৩ই মে – এদিন পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যের ধমনীতে সবচাইতে কম নিরাপদ ও সবচাইতে বেশী নিরাপত্তাহীনতার “তাজা” রক্তস্রোত অহরহ প্রবাহের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কারী পারদর্শিনী, করোনা মহামারীর বীরত্বপূর্ণ মোকাবিলায় দেশের মধ্যে সবচাইতে সফল !( হায় কেরালা! তুমি কি কাঁদছ, না হাসছো ? ) এই স্বঘোষিত তকমায় বিভূষিতা আবির্ভূতা হলেন “গ্রাম জাগরণ”-র বাদ্যি বাজিয়ে,— ‘কৃষকের সঙ্কট’, ‘ক্ষেতমজুরের কাজ’, ‘ফসলের দামের’ স্বপ্নের পসরা সাজিয়ে”। ভয় নাই আর ভয় নাই। আর রেশনে গরিবের চাল চুরি হবেনা, এরাজ্যে আর আত্মহত্যা করবেনা,কৃষক-ক্ষেতমজুর। ফসলের ন্যায্য দাম দেওয়া নিয়ে আর হবেনা বহুরুপী তঞ্চকতা, তস্কর মুক্ত হবে পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি-গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসগুলি আর লুঠের আখড়া থাকবেনা-ওরে “তোরা সব জয়ধ্বনি কর। ”
(২)
২৪ শে মার্চ রাত্রে যখন দেশজুড়ে সরকারী ভাবে ঘোঘণা হচ্ছে লকডাউন তখন সারাদেশে করোনা মহামারীর প্রকোপে সংক্রামিতর সংখ্যা- ৫৬৬, মৃত্যু-১০। লকডাউন নয় নয় করে পঞ্চাশদিন পার করে তৃতীয় দফার শেষে যখন চতুর্থ দফার জন্যে কড়া নাড়ছে তখন সারা দেশে সংক্রামিতের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে লাখের চৌকাঠে আর মৃত্যু আড়াই হাজারের গন্ডী অতিক্রম করে দুরন্ত গতিতে ক্রমবর্ধমান। এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে, লকডাউনের
এই মধ্যবর্তী সময়ে করোনা মহামারীর হামলা মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ ছিলো ? উত্তরটা কিন্তু কঠিন নয় বরং খুব সোজা—(ক) সংক্রমণের সংখ্যা যত দ্রুত ও যতটা বেশী সম্ভব কমিয়ে নিয়ে আসা এবং(খ) সরকারী ব্যবস্থাপনায় আক্রান্তদের দ্রুত সঠিক চিকিৎসার আওতাভূক্ত করা ৷ এবার তাহলে অনিবার্যভাবেই দ্বিতীয় প্রশ্ন সামনে আসে, লক্ষ্য অর্জনে রাষ্ট্রের তাহলে করনীয় কি ছিলো ? গভীর গবেষণা ছাড়াই এর উত্তরে বলা যায়, —১) Human Physiology’র সঙ্গে সঙ্গে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনেও এই অচেনা কিন্তু ভয়ঙ্কর শক্তিধর শত্রুর সর্বগ্রাসী আক্রমণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, আশু ও দীর্ঘকালীন ফলাফল কি হ’তে পারে সে সম্পর্কে রাষ্ট্র পরিচালকদের সংবেদনশীল ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন সম্যক উপলব্ধি এবং সেই অনুসারে দ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ২) বিপর্যয়ের অকল্পনীয় দ্রুত ব্যাপ্তি ও অভূতপূর্ব ভয়াবহতা পরিমাপের ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)’র সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ও পরামর্শ মতো (ক) লকডাউন পর্ব চলাকালে এই সময়ের সদ্ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নির্দিষ্ট সময় সীমা নির্ণয় করে, নির্দিষ্ট নিয়ম ও পরিকল্পনার মাধ্যমে যুদ্ধ কালীন প্রস্তুতি নিয়ে ব্যাপকতম ভিত্তিতে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার বন্দোবস্ত করা,এবং সেই কারনেই প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, বস্তি ধরে ধরে অসংখ্য অস্থায়ী সরকারী পরীক্ষা কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা এবং তারজন্যে প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রস্তুত করা, যা কেরালা করে দেখিয়ে দিয়েছে। খ) যেহেতু দেশে দেশে এই মারণ ভাইরাসের আক্রমণের একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে অসীম ত্যাগ ও সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার কাজে প্রধানত নিয়োজিত আছেন হাজার হাজার চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মী সুতরাং তাদের সর্বাগ্রে সবরকম সুরক্ষা দেওয়ার সময়ানুবর্তী সুব্যবস্থা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে করা, পর্যাপ্ত পরিমাণে পিপিই, মাস্ক, কিট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরবরাহের ব্যবস্থা করা। গ)কেবলমাত্র করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উপযুক্ত পরিকাঠামো (পর্যাপ্ত শয্যা, আইসিইউ, ভেন্টিলেটার ইত্যাদি) সহ পর্যাপ্ত সংখ্যায় হাসপাতাল অথবা চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তোলা এবং সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দ্রুত নিশ্চিত করা। ৩) এতবড়ো একটা বিপর্যয়ের প্রকৃত মোকাবিলায় শূণ্যগর্ভ উন্নাসিকতা পরিহার করে একটি বা দুটি বা তিনটি আনুষ্ঠানিক সর্বদলীয় সভার বাইরেও সবসময় সকলের সঙ্গে আলোচনার, পরস্পর পরামর্শ ও মতবিনিময়ের পথ খোলা রাখা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের সাহায্য গ্রহণ করা, অর্থাৎ এসময় অন্তত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বিবেচনা বোধের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করা। ৪) যতটা যৌক্তিক বা সঠিক কারনেই হোক না কেন লকডাউন মানে কী ? সোজা কথায় এর মানে হলো জনজীবনে সম্পূর্ণ সার্বিক স্তব্ধতা। জনজীবন মানে কী মামুলি ব্যাপার মহাশয় ! ব্যক্তি জীবন,সমষ্টি জীবন—তার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এতগুলো ধারা, উপধারা-এই সমস্ত কিছু নিয়ে সজ্ঞায়িত যে ‘জনজীবন’ তার ওপর রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দেশে আরোপিত সর্বাত্মক স্তব্ধতা,—এই হলো করোনার কল্যাণে হঠাৎ করে কুলীন হয়ে ওঠা বহুল ব্যবহৃত গালভরা শব্দ লকডাউন। এই যে বলা হয়, বলা হয়ে থাকে,‘জনজীবন’,‘ জনজীবন’ ! আচ্ছা,এই জনজীবনের দিগন্ত বিস্তৃত জায়গা যারা আগলে রেখেছেন তাঁরা কারা ? যারা সংখ্যায় ক্ষীণ হলেও বিত্তে দানবীয় ক্ষমতার অধিকারী তারা ? যারা সরকারী ব্যাঙ্ক থেকে নব্বই শতাংশ টাকা ধার নিয়ে এবং সেই ধার শোধ না করে ব্যবসাদার থেকে পুঁজিপতি,পুঁজিপতি থেকে বৃহৎ পুঁজিপতি, বৃহৎ পুঁজিপতি থেকে একচেটিয়া পুঁজিপতি বা হালে বহুজাতিক কোম্পানির কর্ণধারের মুকুট মাথায় নিয়ে রাষ্ট্রের কেষ্টবিষ্টু হয়ে বসেছেন তারা ? আস্ত দেশটাকেই যারা নিজেদের বেপরোয়া লুঠের সাম্রাজ্যে পরিণত করেও প্রধানমন্ত্রীর কৃপাধন্য তারা ? নাকি কেবলমাত্র নিজেদের আখের গোছানোর অভিপ্রায়ে “ যে সুনীল জলধি হতে জননী ভারতবর্ষ একদা ভেসে উঠেছিলেন, সেই জলাম্বুরাশিতেই ভারতবর্ষের আশু বিসর্জন ঘটুক”এই যাদের মনবাঞ্ছা তাঁরা ? এই সকল প্রশ্নমালার প্রকৃত উত্তরের জন্যে আমাদের সততই মাথা নিচু করে গিয়ে দাঁড়াতে হয় কবিগুরুর অনাবিল সৃষ্টির সামনে, “ মাটির পৃথিবী-পানে আঁখি মেলি যবে / দেখি সেথা কলকলরবে / বিপুল জনতা চলে / নানা পথে নানা দলে দলে / যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে / জীবনে মরণে। / ওরা চিরকাল / টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল। / ওরা মাঠে মাঠে / বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে।/ ওরা কাজ করে / নগরে প্রান্তরে।” সুতরাং নগরে প্রান্তরে কাজ করা এই বিপর্যয়ে সম্পূর্ণ বিধ্যস্ত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনজীবনের স্পর্শ সহমর্মিতার সঙ্গে অনুভব করে তাদের হাত ধরা। হ্যাঁ, অবশ্যই বাক্য বাহুল্যে নয়, কাজে।
(৩)
কিন্ত,ছেদহীন স্তব্ধতা নিয়ে পঞ্চাশ দিন পেরিয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রীর গোটা চারেক ভাষণে বাণী বিতরণ আর মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে গোটা পাঁচেক ভিডিও সভা, এছাড়া এই সময়ে আসলে কিছু হলো কী ? বরং দেশ দেখলো সরকারের নির্বিকল্প সমাধির সুযোগে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে তো বাড়লই সেইসঙ্গে আরো দুটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে গেল, ১) মাঝেমাঝে শুধু রকমারি বুলির আতশবাজির প্রদর্শনী ছাড়া প্রকৃত সংকটে, মানুষের বিপদে সরকার আসলে হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে-বসে, ঘুমিয়ে থাকতেই স্বচ্ছন্দ, ২) এত গভীরতর সংকটের সময়েও অথচ প্রতিবাদী কন্ঠের, সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক সক্রিয়তার, মানবিক মূল্যবোধের অন্তর্জলিযাত্রার স্বৈরাচারী নটরাজ নৃত্য কিন্তু চলতেই থাকবে। অতএব কি আর করা, জাতীয় উৎপাদনের অবিচ্ছেদ্য কিন্ত অদৃশ্য বিপুল অংশ পরিযায়ী শ্রমিক— রোজগার হারানো, কপর্দকহীন, ক্লান্ত-শ্রান্ত, পরিবার পরিজন থেকে সুদীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন, বিভ্রান্ত, ভয়ার্ত পরিযায়ী শ্রমিক আক্ষরিক অর্থেই এসে দাঁড়ালেন রাস্তায়। হাতে কড়ি নেই, পেটে দানা নেই, পাশে সরকার নেই কাঁচা রাস্তা,পিচরাস্তা ধরে,রেললাইন ধরে হাজারে হাজারে তারা হেঁটে চলেছেন কতদূর যাবেন, কিভাবে যাবেন কিছুই তাদের জানা নেই কিন্তু তারা এইটুকু বুঝলেন “এই মৃত্য উপত্যকা আমার দেশ নয়”। রেলের চাকার তলায় চিরঘুমে হারিয়ে গেলেন তাদেরই ১৭ জন, যে গোটাকতক শুকনো রুটির গায়ে লেখা ছিলো তাদের ক্লান্ত, অবসন্ন, ক্ষুধার্ত পেটের ঠিকানা তা পথ হারিয়ে গড়াগড়ি খেয়ে রেললাইনেই পড়ে রইলো। তাতে কী এতো সতেরটা ভোটের সতেরটা লাশে রূপান্তর। অনির্দিষ্ট গতি থেকে স্তব্ধ গতি। পরে ট্রাক উল্টে আরো ৫, ট্রাকটর চাপা পড়ে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আরো ২৩, এ আর এমন কি ! এসব একেকটা সংখ্যা বইতো কিছু নয়! তার বাইরেও কাজ হারালেন প্রায় তিন কোটি যৌবন, মজুরি কমলো নব্বই শতাংশ, সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ‘দেওয়া’ নয় কেড়ে ‘নেওয়া’ হলো শ্রমিকের অধিকার, সরকারের বাগাড়ম্বরকে বেআব্রু করে সংগঠিত সমীক্ষা জানিয়ে দিয়েছে “একবেলা না খেয়েই অর্ধেক গ্রাম ভারত” দিন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। অমানবিক রাষ্ট্র অথচ“ভোঁতা, নির্লিপ্ত , ভাবলেশহীন।” মোদি কথিত ২০ লক্ষ কোটি টাকার তঞ্চকতার বিশেষ প্যাকেজও ঠিক তাই- ভোঁতা, নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন। কোনো দিশা নেই, যারা সবচাইতে এই বিধ্বংসী বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত তাদের জন্যে কোথায়, কি, কত বরাদ্দ তার কোনো নির্দিষ্ট ঘোষণা নেই।শুধু শূন্যগর্ভ আস্ফালন আর, বোকা বানানো বক্তৃতা । প্রতিবাদ হলেই স্বৈরাচারের নটরাজ নৃত্য। কিন্তু তাবলে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এইভাবে পাথর চাপা দিয়ে তা যতই শক্তিশালী হোক আটকানো যাবে ? আটকানো যায় ?
(৪)
এই রাজ্যের স্বঘোষিত অভিভাবক, বহুল প্রচারিত বা সর্বাধিক প্রচারিত বাজার কাঁপানো সংবাদ মাধ্যম যারা, এই দুঃসময়ে সরকারী অপদার্থতার বিপ্রতীপে বাংলার মাঠ-পাথার- বন্দরে লাখো হত দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে বামপন্থী কর্মীদের দায়বদ্ধ গৌরবজ্জ্বল সক্রিয় উপস্থিতিকে মোটে দেখতেই পাচ্ছেন না, রাজ্য সরকারের চরম অপদার্থতায় সাধারণ মানুষের চরম ক্ষোভ-বিক্ষোভও যারা শুনতেই পাচ্ছেন না, চাল চুরি বা রেশন কেলেঙ্কারির শাসক দলীয় বেলেল্লাপনাকেও যারা পরিবেশন যোগ্য সংবাদ বলেই মনে করেন না অথবা করোনা মোকাবিলার নামে আত্মপ্রচার সর্বস্ব বিজ্ঞাপনে কোটি কোটি টাকার অপচয়কে যারা অযথা ব্যায় বাহুল্য বলে মানতে নারাজ যথা সময়ে এবং যথোপযুক্ত বিনিময় মূল্যে শুধু মমতায় মজে থাকা বা ডুবে যাওয়া সেই কুলীন সংবাদমাধ্যম সম্প্রদায় কিন্তু এটা সোচ্চারে জানাতে সামান্য কার্পণ্য করেনি যে, রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর “২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ” ভোজবাজির বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। তাঁর কামান, তাঁর তোপ তিনি দেগেছেন, এতে কারুর কিছু বলার থাকতে পারেনা। আর কাঁচের ঘরে বসে ঢিল ছোড়াতো তার স্বভাবসিদ্ধ বিভঙ্গ। কিন্তু মাননীয়া আপনি নিজেকে যে কতগুলি বড় বড় প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন তার মীমাংসা কিভাবে হবে ? কে করবে ? (১) এই রাজ্যে এখন এমন একজন মানুষকেও মাননীয়া খুঁজে বের করতে পারবেন যিনি বলবেন, দুঃসহ এই দুঃসময়ে দক্ষতা , যোগ্যতা, সহমর্মিতা, প্রশাসনিক তৎপরতা নিয়ে তার পাশে সরকার আছে যে কারনে তিনি নিরাপদ বোধ করছেন ! (২) তাঁর কৃপাপ্রার্থী, স্বঘোষিত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ হাতে গোনা কয়েজন ছাড়া রাজ্যের এমন একজন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী, যাঁরা এই কঠিন সময়ে সবচাইতে মহৎ দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন,মাননীয়া দেখাতে পারবেন যিনি বলবেন সত্য চেপে যথেচ্ছ মিথ্যাচার আর বাগাড়ম্বর ছাড়া রাজ্যে এই সময় সরকার তাদের কাঁধে হাত রেখে সাহস যোগাচ্ছে ! (৩) করোনায় সংক্রামিত বা মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য ও সত্য চেপে রেখে মানুষকে আরো বিভ্রান্ত ও ভয়ার্ত করে তোলা ছাড়া এতে সরকারের লাভ কী ? সত্য কী চাপা থাকে ? (৪) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে বলেছিলো,“ পরীক্ষা-পরীক্ষা আর পরীক্ষা” তা কেরালাকে অনুসরণ করে প্রথম থেকেই করোনা ভাইরাস পরীক্ষার এই কাজটা করা হলোনা কেন ? লজ্জা রাস্তায় গড়াগড়ি খাবে তাই! মুখ্যমন্ত্রী একদিন সাংবাদিক দাঁড় করিয়ে সব্জির দোকানে চক দিয়ে ঘটা করে বৃত্ত আঁকলেই করোনা দূর হয় ? (৫) এই সময়ে যারা কাজ হারালেন, মজুরি খোয়ালেন, ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া অসহায় পরিযায়ী শ্রমিক রোজগার হারিয়ে পরিবার পরিজন ছেড়ে নিঃস্ব, সহায় সম্বলহীন ভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্রেফ রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন যথেচ্ছ মিথ্যাচার, রেশন লুঠ, চাল চুরি ছাড়া এই সময় শাসকদল, সরকার তাদের পাশে কোথায় ? (৫) খাদ্য সামগ্রি নিয়ে বা সাহায্য সংগ্রহ করে রান্না করা খাবার যুগিয়ে যারা এই সময় আর্ত মানুষের পাশে, কাছে থাকছেন সেই বামপন্থী কর্মীদের ওপর তৃণমূলী হামলাই বা অব্যাহত আছে কেন ? সরকার, প্রশাসনই বা নীরব কেন ? বলা বাহুল্য এত সব প্রশ্নের একটারও উত্তর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নেই। তাই ঠুনকো অহংকারের গরিমায় আবৃতা মুখ্যমন্ত্রীর শ্লাঘার বর্ম ভেদ করে এই অতি জরুরী প্রশ্ন গুলির প্রবেশ অতএব আপাতত সুদূরপরাহত। কিন্ত এই প্রশ্নগুলিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেন এ সাধ্য মাননীয়ার নেই।
(৫)
আজ এই ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়ে অসহায়, আর্ত মানুষের পাশে থাকার যে অনিবার্য কর্তব্য নির্দিষ্ট ছিলো বামপন্থীদের, হেতু নিরপেক্ষ ভাবেই বামপন্থার প্রতি অসূয়া যাদের তারাও এমনকি মানবেন তাতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বামপন্থী কর্মী বিশেষকরে কচি-কাঁচা ছাত্র- ছাত্রী, তরুণ-তরুণীর দল জানিয়ে দিয়েছে আমরা আছি। তাকিয়ে দেখো “দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে। “মানুষের স্বার্থ ছাড়া আমাদের আর কোনো স্বার্থ নেই”— বলেছিলেন জননেতা জ্যোতি বসু। এই যন্ত্রণা ক্লিষ্ট প্রতিটি প্রহর অতিক্রমেও ইতিহাস সাক্ষী বামপন্থার স্থুলে ভুল নেই। বোঝাপড়ায় সামান্য বিচ্যুতি নেই বৃহত্তর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে সংশ্লেষিত আজকের এই হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে থাকার আন্তরিক প্রয়াস । প্রিয় কবি সুকান্তকে মনে রেখে তাই আজ এই উচ্চারণে গর্ববোধ হয়, ” মৃত্যুর সমুদ্র শেষ ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস / মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস। / লেনিন ভূমিষ্ঠ রক্তে , ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ, / বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন। ”
—————————