কল্পনা গুপ্ত,চিন্তন নিউজ:- বিশেষ প্রতিবেদন: ২০/১০/ ২৪:– বই পড়ার কথা বলতে গেলেই একসাথে এক ঝাঁক বইয়ের মলাট, তার নানান ধরনের লেখা, হরফ,ছবি, দৃশ্য পটের মতন চোখে ভেসে উঠে একটা কোলাজ তৈরি করে। বরণডালায় সুবিনয় রায়চৌধুরী, আশাপূর্ণা দেবী, সত্যজিৎ রায় এঁদের কত ছোটদের গল্পের সম্ভার, কল্পনায় ভেসে যাই। শিবরাম চক্রবর্তীর হর্ষবর্ধন গোবর্ধন আর বিনির গল্প- একটা পাঞ্জাবি সবাই মিলে কেটে কেটে ছোট করে দেওয়ার গল্পে হেসে মরে যেতাম, এখনো যাই। একটু বোঝার বয়স হলে শরৎচন্দ্র, বিমল রায়, শার্লক হোম, শরদিন্দু সমগ্র, রবি ঠাকুরের অল্পবিস্তর পড়া।কলেজে পড়ার সময় থেকে বন্ধুরা একসাথে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঠাকুরের গল্প উপন্যাস পড়া সে এক দারুন সময় কেটেছিল। ধীরে ধীরে কখন যেন প্রবন্ধের প্রতি ঝুঁকে পড়লাম। একটা স্লোগান- শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লব আনে মুক্তি। মনে গেঁথে গিয়েছিল তখন আমি স্কুল টিচার।

যুবক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বসে আছেন গঙ্গার ধারে, বাবার ঋণ যতটা সম্ভব মিটিয়েছেন, নিবিষ্ট মনা দেবেন্দ্রনাথ। হঠাৎ তাঁর পায়ের কাছে উড়ে এলো একটা বইয়ের পাতা হাওয়ায়। হাত দিয়ে তুলে নিলেন পাতাটি। পড়তে শুরু করলেন। চমৎকৃত হলেন। দেখলেন উপনিষদের একটি পাতা। দেবেন্দ্রনাথ পড়া শুরু করেন। ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন। সেই সময় বাংলা তথা ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্ম ধর্ম একটি ধর্মীয় আন্দোলনের নাম। সেখানে অক্ষয় কুমার সেন, কেশব সেন, বিদ্যাসাগর থেকে বহু বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। পরে কেশব সেন বেরিয়ে আসেন এবং তাঁর প্রচেষ্টায় ১৮৭২ সালে সিভিল বিবাহ আইন পাশ হয় অর্থাৎ ধর্মীয় আচারাদি ছাড়াই অযাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠানের বিধানের প্রবর্তন হয় এবং একটি বিবাহ, বর ও কণের বিয়ের বয়স ১৪ এবং ১৮ বছর যথাক্রমে স্থির হয়।

একটা জীবনের বিবর্তনে বই পাঠের প্রভাব প্রত্যক্ষ। আমরা বই পড়ি কেন? উত্তরে বলা যেতে পারে বই পাঠের মধ্যে দিয়ে চিন্তাশক্তির দক্ষতা বাড়ে, মস্তিষ্কের কর্ম ক্ষমতা ও সক্রিয়তা বাড়ে, স্মৃতিশক্তি বাড়ে, লেখার দক্ষতা তৈরি হয়। এগুলির সাথে আরেকটি বিষয় হলো হৃদয়ের। বই পড়ার সাথে সাথে মনের সব বন্ধ জানলা খুলে যায় উদারতা আসে দৃষ্টিভঙ্গিতে। আমাদের ভাবনা পরিণত হয়, ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে।মানবিকতাবোধের জাগরণ ঘটে। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বিনোদনের মাধ্যম হলো বইপড়া। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতায় পড়েছিলাম, “তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি যখন না দেখি।”- এই বিমূর্ত ভাবনার জগতে পাওয়া যায় অনন্ত স্বাধীনতা। ভাবনার এই স্বাধীনতা নিশ্চয়ই ক্রমাগত বই পড়ে গড়ে ওঠা মননেই ধরা পড়ে।
এইবারের দুর্গা পূজার সময় প্রতিবছরের মতন বুক স্টলে বসে আছি, হাতের কাছে কত বই। সাঁতার কাটতে ইচ্ছে হচ্ছিল। সামলে নিয়ে হাতের কাছে ম্যাক্সিম গোর্কির “মা” বইটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। ডুবে গেলাম। মাঝে মাঝে অবশ্যই ক্রেতাদের চাহিদা পূরণের চেষ্টাও চলছিল। বহুদিন আগে মা পড়েছিলাম। তখন কলেজের পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে, আমরা প্রবুদ্ধ তিন বান্ধবী তখন চারপাশ থেকে পাভেলকে খুঁজছিলাম। আবার বইটা পড়ায় ডুব দিলাম একটা কথায় এসে জোর চমকে উঠলাম, ক্রমপরিবর্তনশীল পাভেল মাকে বলছে- ” ঠিক বলেছ মা, মানুষ ভালো নয়। কিন্তু যেদিন জানলুম যে সংসারে ন্যায় বলে একটা জিনিস আছে সেই থেকে আর আমার খারাপ লাগে না কাউকে। এখন তাদের উপর আমার ভারী মায়া হয়। এখন বুঝি লোকগুলো যদি খারাপ হয়েই থাকে সে দোষ ওদের নয়।.. এই হল সত্য কথা মা! এই সত্য তোমায় বুঝতে হবে”।পড়তে গিয়ে আমার মনে হল সবটা বই পড়া হয়ে গেল। বহুদিন আগে পড়েছিলাম আবার পড়া হয়ে গেল।
“মা”পড়ে আমরা তিন বন্ধু মিলে হরিজনপল্লী থেকে প্রায় একশটা বাচ্চা ছেলে মেয়ে ধরে এনে শুরু করে দিয়েছিলাম তাদের পড়ানোর কাজ। প্রায় কুড়ি বছর সেই কাজ অব্যাহত ছিল। বাচ্চারা বড় হয়ে আবার পরের প্রজন্মের বস্তিবাসী শিশুদের পড়িয়েছে। সেখানে গড়ে উঠেছিল বুক ব্যাংক, পড়ুয়ারা হাতে লেখা দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতো। পরে কারিগরি শিক্ষারও ব্যবস্থা হয়েছিল। সেইসব শিশুদের থেকে পরে পিএইচপি ডিগ্রিধারী বিদ্যালয় শিক্ষকও হয়েছিল। আমাদের পাভেল ছিল শংকর। সে আমাদের সাথে সারাদিন থাকতো। কিছুটা পড়াশোনা করেছিল। পরে ও সবজি ব্যবসায়ী হয়েছে। নিজের চারপাশের অন্ধকারের জাল ছিন্ন করতে পারলেও আমাদের স্বপ্নের পাভেলকে আমরা গড়ে তুলতে পারিনি যে কিনা সমাজের শোষিত বঞ্চিত ভুখা মানুষের অন্ধকারের জাল ছিন্ন করবে। তবুও এদিন মা উপন্যাসের উত্তাপ আমাদের প্রজ্বলিত করেছিল, তার আঁচে আজও এই প্রৌঢ বয়সের হৃদয় আবারো উত্তাপে ভরে ওঠে।

বই পড়া আমাদের এই ভাবেই জীবনকে গতিময় কোরে আদর্শকে খুঁজে এনে হাতে ধরিয়ে দেয়। আজ বেপথু যুবশক্তির পথ নিশানা দিতে পারে বই। অবশ্যই সঠিক বইটি সঠিক সময়ে ধরিয়ে দেবার দায়িত্ব অভিভাবকের,শিক্ষকের। তবেই একটা সুস্থ সমাজ গড়ে উঠতে পারে। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৩১ এর ২৩ শে মার্চ ভগৎ সিং ফাঁসি নিশ্চিত জেনেও সমস্ত সময়টা জেলে বসে তিনি প্রচুর বই পড়তেন। তাঁর বই ছিলো রাজনীতিক ও অর্থনীতিক উপন্যাসগুলো, যেমন ডিকেন্স,ভিক্টর হিউগো, গোর্কি,ওস্কর ওয়াইল্ড, লিওনিদ আন্দ্রিভ এদের লেখা উপন্যাসগুলি। মৃত্যুর আগে সরকারকে এক চিঠিতে বলে যান- “অতি শীঘ্রই শেষ সংগ্রমের দুন্দুভি বাজবে। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের দিন ঘনিয়ে আসছে। আমরা এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম এবং এর জন্য আমরা গর্বিত।”
