কলমের খোঁচা

অস্ত্রআইনে সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত প্রথম বাংলার মহিলা বন্দী অগ্নিকন্যা দুকুড়িবালার জন্ম দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য


প্রতিবেদনে রাহুল চ্যাটার্জি:চিন্তন নিউজ:২১শে জুলাই:– প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শিওরে, সক্রিয় যখন বিপ্লবী সংগঠনগুলি ঠিক সেই সময়েই আবির্ভাব অগ্নিযুগের পথিকৃৎ দুকড়িবালা দেবীর। পিতা নীলমণি চট্টোপাধ্যায়, মাতা কমল কামিনী দেবী। জন্ম ২১শে জুলাই ১৮৮৭ “স্বাধীন ভারতবর্ষ চাই”, এই আওয়াজ উঠেছে তখন চারদিকে, চলছে ধরপাকড়, জেরার নামে অকথ্য অত্যাচার, চরমে উঠেছে ব্রিটিশের দমননীতি।

১৯১৭সালের ৮ই জানুয়ারী বীরভূমের নলহাটির কাছে ঝাউপাড়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পাড়ার শীতের সন্ধ্যার ঘটনা। ঘরে ঘরে সকলে শাঁখে ফুঁ দিচ্ছেন। এই পাড়ারই একটি বাড়ী ফণীভূষন চক্রবর্তীর। তাঁর গৃহিনী সন্ধ্যে দীপ জ্বেলে গৃহকাজ সারছিলেন, কোলে কচি ছেলে।
হঠাৎই পাড়া ঘিরে ফেলে পুলিশ বাহিনী, সঙ্গে এক লালমুখো সাহেব। মহিলাটি তাড়াতাড়ি কোলের শিশুটিকে খাওয়াতে যাবেন, এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ে পুলিশ।ভেতর থেকে নারীকন্ঠ সাড়া দিয়ে বলেন ‘ঘরে ছেলেপুলে নিয়ে আমি একা,কি করে দরজা খুলি? পুলিশ দরজায় লাথি মারতে মারতে বলে, না খুললে দরজা ভেঙে ফেলবে তারা।। দরজা খুলে দেওয়ায় পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরের ভেতর। তারা তল্লাশী করতে চায় কারণ খবর পেয়েছে অস্ত্র লুকোনো আছে বাড়ীতে।
গৃহকত্রী রুখে দাঁড়িয়ে বলেন ‘কি করে তল্লাশী করবে ঘরে আমি একা মেয়ে,দাঁড়ান পাড়ার লোক ডেকে আনি’। পাড়ার লোকের উপস্থিতিতে তল্লাশী চলে, কিন্তু কিছুই পাইনি পুলিশ। পাবে কি করে, লোকজন ডাকার নামে মা বাচ্চার কাঁথার মধ্যে অন্য একটি বাড়ীতে লুকিয়ে রেখে আসে অস্ত্র। হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে পুলিশ। হঠাৎই এক ব্রিটিশ দরদী পড়শী একটি বাড়ী থেকে উদ্ধার করে এনে দেয় সাতটি জার্মান মাউজার(পিস্তল)।
এই সাদামাটা মোটামুটি লেখাপড়া জানা গৃহস্থ গিন্নিটি সাধারণ ছিলেন না। ছিলেন যুগান্তর দলের এক সক্রিয় সদস্যা যিনি নানাভাবে সাহায্য করতেন সশস্ত্র বিপ্লবীদের,তাদের নিজের বাড়ীতে লুকিয়ে রেখে, খাবার খাইয়ে,কাগজপত্র লুকিয়ে রেখে, ও অস্ত্র লুকিয়ে রেখে।
পুলিশ পর্যন্ত হতবাক এহেন এক সম্ভ্রান্ত বাড়ীর গৃহকত্রী কিনা বিপ্লবী সেই ভেবেই.. অস্ত্র সহ গ্রেপ্তার হন তিনি। ছোট্ট শিশুটি পড়ে কাঁদতে থাকে ঘরে। দুকড়িবালা দেবী অস্ত্র আইনে প্রথম সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিতা মহিলা। মোটামুটি লেখাপড়াটা জানতেন দুকড়িবালা, দেশের অবস্থা, মেয়েদের অবস্থা ভাবাতো তাঁকে।

রানীগঞ্জের কাছে সিয়ারসোল গ্রামে সে-সময় যুগান্তর দলের একটি কর্মঠ সংগঠন গড়ে উঠেছিল। ছিলেন বিপ্লবী জ্যোতিশচন্দ্র ঘোষ, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির মতন বিপ্লবীরা। এঁদের সান্নিধ্যে নিজেকে বিপ্লব মন্ত্রে শিক্ষিত করে চলেছিলেন দুকড়িবালা,চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিঃশব্দে বিপ্লবী কার্যকলাপ সবার অগোচরে। নিবারণ ঘটকের মাসী হওয়ার সুবাদে তিনি ছিলেন সবার মাসীমা। এঁরা সবাই ছিলেন সিয়ারসোলের ‘আত্মোন্নতি সমিতি’-তে। এটি আসলে ছিল ‘যুগান্তর’ দলের গুপ্ত সমিতি। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর রডা কোম্পানির পিস্তল এবং কার্তুজ লুঠের ঘটনায় যুক্ত হয়ে পড়েন নিবারণচন্দ্র ঘটক এবং বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী। পুলিশের নজর এড়িয়ে বিপিনবিহারী আত্মগোপন করেন সিয়ারসোলে। ‘রণেন গাঙ্গুলী’ ছদ্মনামে তাঁকে সিয়ারসোল রাজবাড়িতে কাজে ঢুকিয়ে দেন নিবারণচন্দ্র। প্রায় দু-বছর সেখানে তিনি আত্মগোপন করে থাকেন। ৮ জানুয়ারি ১৯১৭ তারিখে মুরারিপুকুর ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার হন বিপিনবিহারী। লুট করা অস্ত্র বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে নিবারণচন্দ্রের ওপর। তিনি সেগুলি রেখে আসেন ঝাউপাড়াতে। পরের দিনই রণেন গাঙ্গু্লী এবং অনুকূলচন্দ্র নিয়ে আসেন আরও কিছু কার্তুজ এবং পিস্তল। সেগুলি লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব পড়ে দলের কর্মী মাসীমা দুকড়িবালার ওপর। গ্রেপ্তার হলেন নিবারণ ঘটক। সিউড়ির স্পেশাল ট্রাইবুনালে বিচার চলে তাঁর। স্কুলের পরিচালন সমিতির ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারির নিবারণচন্দ্র ঘটককে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়। নিবারণচন্দ্র এবং দুকড়িবালা—দুজনের বিচার একসঙ্গে চলে। নিবারণের পাঁচ বছর এবং দুকড়িবালার দু-বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তাঁকে আনা হয় প্রেসিডেন্সী জেলে। সেখানে তাঁর উপর জেল কতৃপক্ষ শ্রমের নামে অকথ্য অত্যাচার চালাতো। যত রকমের কাজ যা একটি নারীর পক্ষে অত্যন্ত দূরহ সেই ধরণের কাজ তাঁকে করতে দেয়া হত। যথাসময় সমাধা করতে নাপারলে শাস্তির নামে চলতো খেতে না দেওয়া, দৈহিক অত্যাচার ও আলোবাতাসহীন সেলে বন্ধ করে রাখা। এত অত্যাচারেও একটুও দমেননি তিনি। রোজ তাঁকে ভাঙতে দেয়া হত একমণ ডাল।তবুও তিনি তাঁর বাবাকে লেখা চিঠিতে লিখতেন তিনি ভালো আছেন কোনো কষ্ট নেই, ছেলেমেয়েরা যেন ভালো থাকে,তাদের যেন কোনো কষ্ট না হয়। এই সময়ে প্রেসিডেন্সী জেলে সাজা কাটছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম মহিলা রাজবন্দী ননীবালা দেবী। জেলে ননীবালা দুকড়িবালার সান্নিধ্যে আসেন, দুকড়ির দূর্দশা ও ভগ্ন স্বাস্থ তাঁকে যেমন ভাবালো তেমনি কৌশল ও শেখালো। ননীবালা বলেন দুকড়িবালা ব্রাহ্মণ মহিলা, তিনি তাঁর হাতের রান্নাই খাবেন। এই ভাবে ওই কঠিন কাজগুলো থেকে অব্যাহতি পান দুকড়িদেবী, ও তাঁর স্বাস্থেরও উন্নতি হয়।

দুবছর পর জেল থেকে ছাড়া পান দুকড়িবালা। তারপর সবটাই ইতিহাস। কেউ আর তাঁর কোনো খবর পায় নি। অনাদরে, অবহেলায় বাকি জীবন কেটেছে তাঁর। অস্ত্র আইনে সশ্রম কারাদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত প্রথম মহিলা সংগ্রামীর কথা জানতে পারলোনা স্বাধীন ভারতবর্ষ, কোলের সন্তানকে যিনি মাতৃদুগ্ধ থেকে বন্ঞ্চিত করে জেল খেটেছেন, অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছেন শুধুমাত্র দেশ স্বাধীন হবে বলে, শোষণমুক্ত হবে বলে। দুকড়িবালা দেবী ও নিবারণচন্দ্র ঘটকের বিপ্লবী কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় সৌরেন্দ্রকুমার চক্রবর্তীর ‘শেকল ভাঙার পণ’ ও ‘বাংলার মেয়ে দুকড়িবালা’ শীর্ষক গ্রন্থে। দুকড়িবালা দেবীর মৃত্যু হয় ২৮শে এপ্রিল ১৯৭০সালে। তাঁর সন্তানেরা,স্বামী আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। নিশঃব্দে কালের স্রোতে হারিয়ে গেছেন তিনি। আজ শুধু এইটিকুই সান্ত্বনা যে অস্ত্র আইনে প্রথম সশ্রম কারাদন্ডপ্রাপ্ত মহিলা বন্দী হিসেবে ননীবালা দেবীর নামটি নথিভুক্ত আছে…
দুকড়িবালাদেবী নিবারণ ঘটককে দৃঢ় স্বরে বলেছিলেন “তোমরা যদি দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারো তোমদের মায়েরাও পারে..”


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।