একটি বিশেষ প্রতিবেদন : ডাঃ স্বপ্না চট্টরাজ চিন্তন নিউজ:৩১শে মে:– ‘হু'(W. H. O.) ১৯৮৭সালে বিশ্ব তামাক বর্জন বিরোধী দিবস চালু করে। বিশ্ব জুড়ে ২৪ঘন্টা সময়সীমা ধরে তামাক সেবনের সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকাতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবসটি পালন করা হয়। ‘হু'(W. H. O.) এর ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীতে তামাক সেবনের ফলে বছরে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। আমাদের দেশে প্রতিদিন ২৫০০ জন মানুষ ধূমপান ও তামাক আসক্তির কারনে মারা যান। এদের মধ্যে যারা ধূমপান করতেন শুধু তারাই নন, প্যাসিভ স্মোকিং এর জেরেও মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬ লাখ মানুষের। তামাক সেবনে ভারত দ্বিতীয় স্থানে আছে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০শতাব্দীর দিকে মায়া সভ্যতার মানুষেরা ধূমপান ও তামাক পাতা চিবানো শুরু করে। মায়ানরা তামাক পাতার সাথে বিভিন্ন ভেষজ গাছগাছড়া যোগ করে অসুস্থ ও আহতদের চিকিৎসা করতো।
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপের দেশগুলো যখন পরস্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত তখন সৈন্যদের মধ্যে ধূমপানে আসক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সৈন্যদের মধ্যে দ্রুত সিগারেটের নেশা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সিগারেটের আগুনে কাঠের তৈরী ঘর বাড়ি পুড়ে যাওয়ার কারণে ধুমপান নিষিদ্ধ করন আইন জারি করা হয় বেশ কিছু দেশে। আইনভঙ্গ কারীকে শাস্তি দেওয়া হতো। এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। কিন্তু তামাকের ব্যবহার বন্ধ করা যায় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ইওরোপের ভেঙে পরা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আবার প্রয়োজন হয় তামাকের। আমেরিকা থেকে ৯০হাজার টন তামাক ইউরোপে আসে।
এবার আসা যাক স্বাস্থ্যের উপর তামাকের প্রভাব বিষয়ে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্রাথমিক ভাবে গবেষণা মূলত তামাক ধূমপান বিষয়ের উপর করা হয়েছে। ১৯২৪সালে আমেরিকান চিকিৎসক আইজাক অ্যাডলার প্রথম ধূমপানের সাথে ক্যান্সার এর সম্পর্কের কথা বলেন।
ধূমপান অর্থ কোনো তামাকজাত দ্রব্যের ধোঁয়া শ্বাসের মাধ্যমে টেনে নেওয়া বা বের করে দেওয়া। ধূমপান সমগ্র বিশ্বের কাছে এক মহাবিপদ । তাই আজ গোটা বিশ্বজুড়ে ধূমপানের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ ধূমপানের শিকার হয়ে দিনের পর দিন সুন্দর স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ধূমপান জনিত ক্যান্সার সহ অন্যান্য রোগে মারা যাচ্ছে। কেউ কেউ বিভিন্ন ঘাতক রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অসহায় ভাবে মানব সমাজে বেচে আছে। জীবনীশক্তির, ফুসফুস, মস্তিষ্কের, হৃৎপিন্ডের ক্ষতি হতে শুরু করে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, আর্থিক সব ধরনের ক্ষতি ধূমপান করে থাকে। ধূমপায়ী ক্ষতি করে নিজের, পরিবারের, সাথী-দশর্কের, সহযাত্রী, সহপাঠী ও তার সঙ্গে অবস্থানকারী সকল মানুষের।পার্শ্বস্থ নিষ্পাপ শিশুর, গর্ভস্থ ভ্রুণের, বীর্যের ভিতরে শুক্রকীটের, ভবিষ্যৎ বংশধর এবং দেশ ও জাতির। তাই সমগ্র পৃথিবীর সর্বস্তরের মানুষকে ধূমপান করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
আমাদের দেশে গ্রামের মানুষ বিড়ি, হুকো বেশি পছন্দ করে। শহরের পুরুষদের পছন্দ সিগারেট চুরুট। বয়ঃসন্ধির সময়ে স্কুল কলেজের বন্ধুদের পাল্লায় পরে যারা একবার ধূমপান করেছেন তারা আর নেশা ছাড়তে পারে নি। ধূমপানের প্রতি টানে মানুষের দেহে যতটুকু ধোঁয়া প্রবেশ করে তাতে রয়েছে ৫০টির বেশি রাসায়নিক পদার্থ। তামাকে নিকোটিন নামে আরও একটি উপাদান আছে যা আসক্তি সৃষ্টির জন্য দায়ী।
ধূমপানের জন্য কি কি রোগ হয় দেখা যাক
১-হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক
২-ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিসিস (C.O.P.D)
৩- এমফাইসিমা, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসের ক্যান্সার
৪-প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সার
৫-ল্যারিংসের ক্যান্সার ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার
৬-উচ্চ রক্ত চাপ ও প্রান্তীয় রক্তনালীর রোগ
৭-বাজার্স ডিজিজ
৮-গ্যাসট্রিক আলসার, হজমশক্তির বিনাশ
৯-কিডনী, মূত্রাশয় মূত্রনালীর নানা সমস্যা হয়।
১০-প্রজননতন্ত্রের গুরুতর গোলযোগ ও যৌন দূর্বলতা হয়ে থাকে
১১-ধূমপায়ী নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের হার বেশি
১২-অকালে শিশুর জন্ম হয়(Premature birth)
১২-জন্মের সময়ে নবজাতকের ওজন আদর্শ ওজনের তুলনায় কম হয়।
১৪-সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম ( S. I. D. S) এর হার ১.৪-৩/:বেড়ে যায়।
সেজন্য ধূমপান কোনো ভাবেই করা যাবে না। এই অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসক এর পরামর্শ নিতে হবে।
ধূমপানের সাথে সামাজিক অবক্ষয়ের সংযোগ আছে। নেশার দাসত্ব এক অর্থে মানবিক পরাজয়। শিক্ষক ও ডাক্তার দের জন্য ধূমপান একটি মারাত্মক অবক্ষয়। বর্তমানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়া ছাত্রী দের মধ্যে প্রকাশ্যে ধূমপানের প্রবণতা বেড়ে গেছে। অনেক সময় একটা সিগারেট মুখে মুখে ঘোরে। ফলে একজনের জীবাণু অন্যজনের মধ্যে ছড়িয়ে যায়।
তামাক জাত দ্রব্যের অর্থ কি। তামাক পাতা বা উহার নির্যাস থেকে প্রস্তুত যে কোনো দ্রব্য যাহা চোষন বা চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। যেমন-গুল, জর্দ্দা, নস্যি, খৈনি। এগুলো খেলে ক্যান্সার হয়। আমাদের গ্রামে গঞ্জে মহিলারা জর্দা, গুল বেশি ব্যবহার করেন। এসব নেশার দ্রব্য ক্ষতি করে দাঁত ও জিভের। খৈনির খদ্দের মুলতঃ বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, ঠেলা ওয়ালা, মুটে মজদুর। যেহেতু দামে কম তাই স্কুল পড়ুয়া কম বয়সী ছাত্ররা খৈনির নেশা ধরে। গালের দুপাশে, দাঁতের সামনে খৈনি, গুড়াখু রাখার ফলে গালের বা ঠোঁটের কিছু অংশ সাদা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। নরম ভাব নষ্ট হয়ে গিয়ে জায়গাটা শক্ত হয়ে যায়। জ্বালা করে এবং অস্বস্তি বাড়ায়। একে লিউকোপ্লেকিয়া বলা হয়। এর থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। বেশি পান মশালা খেলে সাবমিউকাস ফাইব্রোসিস হয়। মুখের ভেতর তালুর পেছনে মিউকাস মেমব্রেন শক্ত হয়ে যায়। রোগী মুখ খুলতে পারে না। ঢোক গিলতে পারে না এবং এটা ম্যালিগন্যান্ট এ পরিনত হয়।
সর্বশেষে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো নিজেরা ধূমপান ও তামাক সেবন বর্জন করতে হবে। ধারাবাহিক সচেতনতা মূলক প্রচার অব্যাহত রাখতে হবে।
সরকার এবং সমস্ত প্রতিষ্ঠান গুলিকে কে
নিষিদ্ধ এলাকা যেখানে ধূমপান করা যাবে না (No smoking zone)চিন্হিত করতে হবে, যেমন যে কোনো পাবলিক প্লেস যেমন- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধাসরকারী অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস, বেসরকারী অফিস, লাইব্রেরী, লিফট , হাসপাতাল, আদালত ভবন, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল ভবন, পাবলিক টয়লেট, শিশু পার্ক ইত্যাদি ।
ধূমপান ও তামাক বর্জন বিরোধী দিবস কোনো বিশেষ একদিন নয় পালিত হোক প্রতিদিন প্রতি ঘরে ।