কল্পনা গুপ্ত:চিন্তন নিউজ:২৮শে অক্টোবর – ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর আয়ারল্যান্ডের ড্যানগানন শহরে জন্ম হয় মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের, যিনি পরবর্তীকালে ভগিনী নিবেদিতা নামে পরিচিতা। বিদ্যালয় শিক্ষা শেষ করে তিনি ১৮৯০ এ লন্ডনে উইম্বল্ডনের নতুন বিদ্যালয়ে শিক্ষয়িত্রীর কাজ শুরু করেন। সেই সময়ে তিনি শিশু শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৮৯৫ এর নভেম্বরে এক অপরাহ্নে লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে মিস্টার স্টার্ডির বাড়ির ড্রইংরুমে স্বামী বিবেকানন্দের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাত ঘটে। স্বামীজীর প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্ব তাঁকে মুগ্ধ করে। মার্গারেট স্বামীজীর শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। তাঁর আদেশে মার্গারেট ১৮৯৮ এ ভারতে আসেন। এরপর স্বামীজীর অভিভাবকত্বে নিজেকে এদেশের সংস্কৃতিতে দীক্ষিত ও শিক্ষিত করে তোলেন। ভারতবর্ষকে তিনি মায়ের আসনে বসান। এক চিঠিতে স্বামীজী তাঁকে লিখেছিলেন, ” তোমাকে অকপটভাবে বলিতেছি, এখন আমার দৃঢ বিশ্বাস হইয়াছে যে, ভারতবর্ষের কাজে তোমার অশেষ সাফল্যলাভ হইবে। ভারতের জন্য, বিশেষত ভারতের নারীসমাজের জন্য, পুরুষ অপেক্ষা নারীর – একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন। ……তোমার শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, অসীম প্রীতি, দৃঢ়তা, এবং সর্বোপরি তোমার ধমনীতে প্রবাহিত কেল্টিক রক্তই তোমাকে সর্বোপ্রকারে সেই উপযুক্ত নারী রূপে গঠন করিয়াছে।”
স্বামীজীর আদেশে তিনি মেয়েদের জন্য কলকাতার বাগবাজারে একটি বিদ্যালয় গড়ে তোলেন যেটি বর্তমানে নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয় নামে খ্যাত। তিনি ১৭ নম্বর বোসপাড়া লেনের একটি বাড়িতে থাকতেন ১৯০২ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত। সেটি বর্তমানে পূনর্নির্মিত হয়েছে। শিক্ষকতার সাথে সাথে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন প্রবন্ধ, বই ইত্যাদি লেখার কাজে। তাঁর বিখ্যাত বই কালী দ্যা মাদার। একবার কালীঘাট মন্দিরে এই বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে রক্ষণশীল হিন্দুদের মধ্যে ঝড় তোলেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামে চরম ও নরমপন্থী উভয়ের সাথেই তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য যেকোন প্রকার গঠনমূলক সিদ্ধান্ত ও আলোচনা করতেন। তাঁর প্রভাবও ছিলো সশস্ত্র বিপ্লবী দের ওপর প্রত্যক্ষভাবে। স্বামীজী যথার্থই তাঁকে সিংহীনির সাথে তুলনা করেছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, অরবিন্দ ঘোষ, গোপালকৃষ্ণ গোখেল, বিপিন পাল ও অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা নিবেদিতার একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তাঁদের সাহস ও শক্তি জোগাতেন নিজের জীবন বিপন্ন করে। স্বামীজীর জীবনাবসানের পরে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল না ঘুচলে ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটবে না। শিল্প সংস্কৃতিতে জাতীয় ঐতিহ্যের প্রাণপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হলে ভারতকে মুক্ত করতে হবে বিদেশি শাসন থেকে। তাঁর কথা ও কাজে ছিলো দেশপ্রেমের আগুন। তারই শিখায় যুব সমাজে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। অতিমারি প্লেগের সময়ে এই যুব সমাজকেই সাথে নিয়ে প্রাণ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আর্ত, পীড়িতের সেবায়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লোকমাতা নামে আখ্যায়িত করেন। বিজ্ঞানাচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুও তাঁর অত্যন্ত গুণমুগ্ধ ছিলেন। তাঁর চরম হতাশার দিনে নিবেদিতার সাহচর্য ও সহযোগিতায় তিনি বিজ্ঞান সাধনায় মগ্ন হতে পারতেন। শিল্পী নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখ শিল্পকর্মে প্রেরণা পেতেন, তাই অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ” তাঁর কাছে গিয়ে কথা কইলে মনে বল পাওয়া যেতো”। জাপানী শিল্পী ওকাকুরা লিখিত আইডিয়াল অফ দি ইস্ট গ্রন্থ রচনাতেও নিবেদিতার অবদান ছিলো অনস্বীকার্য।
স্বাধীন ভারতের স্বপ্নে বিভোর নিবেদিতা ভারতের জাতীয় পতাকার একটি নকশা এঁকেছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিলো ভারতের জাতীয় পতাকায় শক্তির প্রতীক স্বরুপ বজ্রচিহ্ন অংকিত থাকবে। নিবেদিতা বলতেন, ” আমরা আশা করবো না, নিরাশও হবো না, আমরা দৃঢ নিশ্চয় – আমরা অগ্রগামী মরিয়া দল। আমরা নিজেদের শরীর দিয়ে সেতু প্রস্তুত করব, পরবর্তী সৈন্যদল সেই সেতুর ওপর দিয়ে পার হয়ে যাবে।”
১৯১১ সালের ১৩ ই অক্টোবর হিমালয়ের নির্জন কোলে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হন। শ্মশানপ্রান্তের ওই পবিত্র ভূমির উপর নির্মিত নিবেদিতার স্মৃতি স্তম্ভটি ঘোষণা করছে, এখানে ভগিনী নিবেদিতা শান্তিতে নিদ্রিত- যিনি ভারতবর্ষকে তাঁর সর্বস্ব অর্পণ করেছিলেন।