রাজ্য

আজ “আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস”


গৌতম প্রামানিক: চিন্তন নিউজ:৮ই সেপ্টেম্বর,২০২০:- ১৯৬৫ সালে ৮–১৯ সেপ্টেম্বর ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের সমস্ত দেশের শিক্ষা মন্ত্রীদের নিয়ে সম্মেলন। সেখানে শপথ গ্ৰহন হয় “এই গ্ৰহ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ” করা হবে। সেই মতন পরের বছর ১৯৬৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রতি বছর এই দিনটাকে বিশ্ব জুড়ে “আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস” হিসেবে চিহ্নিত করণ করার সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্ব সংস্থার এই সিদ্ধান্ত কে আমরা মান্যতা দিয়ে প্রতি বছর আমরাও এই দিনটাকে বিভিন্ন রকম ভাবে পালন করে থাকি।

১৯৪৭ সালে ১৫ অগাষ্ট দেশ স্বাধীন হলেও দেশের সরকার কখন এই বিষয়ের ওপর যত্নবান ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই দারিদ্রতা, বঞ্চনা, নারী লাঞ্ছনা, শিশু শ্রমিকের হার বাড়তে থাকে।

স্বাধীনতার ৩০ বছর পর পশ্চিম বঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থার এক একটি দিক জনগণের সামনে প্রস্ফুটিত হতে লাগলো, প্রাথমিক শিক্ষায় ও মাধ্যমিক স্তর অবৈতনিক হলো, পঞ্চায়েতি ব্যাবস্থা গড়ে উঠলো– ত্রিস্তর পঞ্চায়েত তৈরি হলো, ভূমিহীন কৃষক ভূমি সংস্কারের মধ্য দিয়ে জমির মালিক হলো, ফলে প্রান্তিক মানুষের শিরদাঁড়া সোজা হতে লাগলো প্রতিটি ব্লকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রর মাধ্যমে জন স্বাস্থ্যচেতনা গড়ে উঠলো। তা সত্বেও ততৎকালীন বামপন্থী ফ্রন্ট সরকারের কাছে মনে হলো কিছু একটা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। তাহলো নিরক্ষরতা। নিরক্ষর কৃষক ও নারী সমাজের মধ্যে এতোটুকুও অগ্ৰগতি হচ্ছে না, তারা পরনির্ভরশীল হয়ে থাকছে, শ্রমিক শ্রেণীর ওপর থেকে বঞ্চনার বা শোষণের মধ্য দিয়ে প্রভু মালিক দাসত্ব বজায় থেকেই গেছে। ফলে ইউনেস্কোর পরিকল্পনার ভিত্তিতে সাক্ষরতা বা নিরক্ষরতা দূরীকরণ আইন প্রণয়ন প্রতিষ্ঠিত হলো, এবং দেশের সরকারের ওপর বিভিন্ন প্রকার আন্দোলন কর্মসূচির দ্বারা নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও সাক্ষরতা প্রসার ঘটানোর পরিকল্পনা গ্ৰহন করাতে বাধ্য করা হলো। আজো বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ নিরক্ষর তারমধ্যে ৬০ শতাংশ নারী।

আজও বিশ্বব্যাপী বহুরূপ বৈষম্য দেখা দেয়, অপুষ্টি, জাতপাতের বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য, ফলে ১৯৬৫ সাল থেকে আজো আমরা পারিনি নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে। যদিও এর একটা অন্যতম কারণ হলো বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সদিচ্ছার চরমতম অভাব। বিশ্ব সংস্থার সদস্য ছিল প্রায় সকল দেশ। আমার ভারত একজন অন্যতম সদস্য। দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমাদের দেশ সাম্রাজ্যবাদ তাবেদার। ফলে লক্ষনীয় বিষয় হল বিশ্ব সংস্থার সদস্য, সমস্ত ধনী দেশ গুলো
তারা অবশ্যই তাদের মর্জিমাফিক অংশগ্রহণ আবার প্রত্যাহার সাক্ষরতা আন্দোলন ব্যাপক বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেমন, শক্তিশালী দেশগুলোর ভুমিকা উল্লেখযোগ্য নয়, ১৯৮৫-৮৬ বেশ কিছু দেশ ইউনেস্কোর সদস্য পদ প্রত্যাহার করলো, আবার পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের ইউনেস্কোর সদস্যপদ পুনরায় গ্ৰহণ করলো।এই অবস্থার মধ্যে থেকেও পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের সফল পদক্ষেপ, প্রতিটা জেলার “জেলা সাক্ষরতা সমিতি” গঠন। যদিও এর পিছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার একটা বিশাল ভূমিকা পালন হয়েছে। এর ফল স্বরূপ বয়স্ক ও বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠল আমার রাজ্য জুড়ে, সমগ্ৰ দেশের কাছে একটা মডেল তৈরি হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি সকলের অগোচরে দেখা গেলো বিদ্যালয় ছুট ব্যাপকভাবে কমতে শুরু করলো প্রাথমিক থেকে উচ্চপ্রাথমিকে, স্বাভাবিক ভাবেই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হু হু করে বাড়তে লাগলো। অবশ্যই রাজনৈতিক গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সরকারের বিরাট সাফল্যের পথ দেখালো।

এই সাফল্যের পিছনে বহু মানুষের অবদান অনস্বীকার্য, যেমন, শ্রদ্ধেয় সত্যেন মৈত্র!! ওনার বসত বাড়িতেই উনি গড়ে তুললেন বয়স্ক ও নারী শিক্ষা কেন্দ্র!! আজ পূর্ব কলকাতার বেলেঘাটায় সি আই টি মোড়ে “স্টেট রিসোর্স সেন্টার”, ওটাই শ্রদ্ধেয় সত্যেন মৈত্রের বাড়ি। নিরক্ষরতা দূরীকরণ আন্দোলনে ওনার প্রয়াণের পর ওনারই স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে উঠেছে “সত্যেন মৈত্র জনশিক্ষা সমিতি” এছাড়াও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ওপর তৈরি হলো “বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি”! এই দুই সংগঠন দ্বারা তৈরী হলো সাক্ষরতার পাঠক্রম।প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, তৃতীয় ভাগ বই। মাতৃভাষা জ্ঞান, হিসেবনিকেশ, গান, হস্ত শিল্প, তার মধ্য দিয়ে স্বনির্ভরতা, অর্থাৎ নিজে অথবা অংশীদারি ব্যাবসা, ব্যাংকের কাজ, সামাজিক উন্নয়ন ও বৈজ্ঞানিক চেতনা!!

পুনরায় ২০১১ সালে ১৩ মে আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই সুপরিকল্পিত বিশাল কাজ সবটাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। প্রতিষ্ঠিত প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ এক সরকার পশ্চিমবঙ্গবাসী ১৯৭৭ সালে নির্বাচন করেছিলেন, তার বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক এবং গঠনমূলক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। জেলায় জেলায় গড়ে ওঠা “জেলা সাক্ষরতা সমিতি”, ব্লকে ব্লকে গড়ে ওঠা বয়স্ক ও নারী শিক্ষা কেন্দ্র গুলো সব আজ স্তব্ধ!! আমার রাজ্য সাক্ষরতার সাফল্য ও অগ্ৰগতির জন্য বিশ্ব সংস্থায় সংবর্ধিত!! এটাও একটা ইতিহাস!!

কিন্তু, আজ নিরক্ষরতা দূরীকরণ প্রশ্নের মুখে!?
পাশাপাশি দেশের সরকার এক অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করছে, শুধুমাত্র ধর্মীয় মেরুকরণ ছাড়া তার আর কোনো বিষয় বস্তু নেই!! অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে, বৈজ্ঞানিকমনস্কতাকে অস্বীকার করে অবাস্তব ধর্মীয় আবেগের দেশ পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গি সমাজকে ভাগাভাগি, সমাজে চরমতম বৈষম্যের সৃষ্টি, এরই মধ্যে দেশের সরকারের অগণতান্ত্রিক ভাবে তৈরি শিক্ষা নীতি ঘোষণা। যেখানে উল্লেখযোগ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় বেসরকারিকরণের পথ তৈরি, আমার মাতৃভাষা বাংলাকে অমর্যাদা, শিক্ষায় ধর্মের অনুপ্রবেশ এবং বাদ দেওয়া বা উল্লেখযোগ্য ভাবে উল্লেখহীন ” সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার” কথাটা।

প্রকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার করার প্রবল প্রচেষ্টা।আসুন ঐক্যের মধ্যে জনমত গড়ে তুলি–বর্তমান রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা বিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।