জেলা

নদীতে ভেসে আসা মরা গাছের গুঁড়ি কিম্বা শিকড় জীবন্ত জলপাইগুড়ির কাটুমকুটুম শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায়।।


দীপশুভ্র সান্যাল: চিন্তন নিউজ:১২ ডিসেম্বর,২০২৩:- প্রতিভা থাকা আর সেটাকে চিনে নিয়ে তার সদব্যবহার করা দুটোই একসাথে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু, নিজের প্রতিভার উপর আস্থা রেখে জীবন অতিবাহিত করে বিশ্ব দরবারে শিল্পকে মেলে ধরতে পারার অনন্য নজির বনমালী সরকার। ভয়াল তিস্তা নদীতে ভেসে আসা বিভিন্ন গাছের গুঁড়ি এবং শেকড় এই শিল্পীর হাতের ছোঁয়া পেয়ে পাড়ি দিয়েছে দেশ বিদেশ সর্বত্রই। জলপাইগুড়ি শহরের সেন পাড়ার বাসিন্দা এই কাটুমকুটম শিল্পীর নাম ছড়িয়ে রয়েছে এশিয়া থেকে ইউরোপ সহ বিশ্বজুড়ে।

তিস্তার বাঁধ লাগোয়া বাড়ি বনমালী সরকারের। পেটের দায়ে কাঠ, লোহার কাজ করতেন তিনি। কিন্তু কথায় রয়েছে না, প্রতিভাকে কে লুকিয়ে রাখতে পারে! নদীতে ভেসে আসা গাছের গুড়ি, ডাল এবং শেকড়ের দিকে তাকিয়ে অবসর সময়ে বিভিন্ন চিত্র খুঁজে পেতেন তিনি। কখনো নারীর লাস্যময়ী রূপ, কখনো বা গজমুখের আকৃতি। এভাবেই একদিন নদী থেকে গুড়ি তুলে তাকে আকৃতি দেওয়ার চেষ্টা শুরু। তারপর থেকেই তার হাত থেকে বেরোতে থাকে একের পর এক অদ্ভুত সৃষ্টি।

তার হাতের ছোঁয়াতে প্রাণ পায় ওই মরা কাঠগুলো। তাঁর বাড়ি দুর থেকেই চেনা খুব সহজ। বাড়িটিকে মৃত গাছের সংরক্ষণ কেন্দ্র বললেও বোধ হয় ভুল হবে না। দীর্ঘ তিন দশক ধরে নিজের বাড়িতে বসেই এই শিল্প করে চলেছেন তিনি। কোন শো পিস হোক কিংবা সেন্টার টেবিল, টি টেবিল অথবা বসার সোফা সবই তিনি তৈরি করছেন তিস্তা থেকে ভেসে আসা গাছের গুঁড়ি, শিকড় দিয়ে। তার কাছে এই কাতুমকুটুম শিল্পকলা শিখতে একসময় অনেকে আসতেন। তার কাজের প্রদর্শনী দেখেছে ভারতের অনেক শহরও।

তাঁর শিল্প এবং পরিচয় গোটা বিশ্বে সারা ফেললেও কোথাও যেন অতৃপ্ত এই শিল্পী। তার কথায়, ‘এই শিল্পের পেছনে অনেক পরিশ্রম ও বলিদান রয়েছে। আমার তৈরি কাটুমকুটুম শিল্প সামগ্রী ছড়িয়ে পড়েছে ইতালি, জার্মান, আফগানিস্থান, আমেরিকা, পাকিস্তান পর্যন্ত। কিন্তু নিজের দেশের ক্ষেত্রে এই শিল্পের প্রসার সেভাবে হয়নি।’ সরকারি বিভিন্ন শিল্পমেলায় প্রায়শই ডাক পান তিনি। সেখানে তার শিল্পকে তুলে ধরেন বনমালী। ‘এই শিল্পের কদর হয়তো বোঝে না এখনকার মানুষ!’ আক্ষেপের সুরে বললেন বনমালী সরকার।

তার যুক্তি, আমাদের রাজ্যে এবং দেশের মানুষের কাছে কতুমকুটুম শিল্প বিস্তারের ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত অভাব আছে। আমার বয়স হচ্ছে তাই আমি নিজের শিল্পের উত্তরাধিকারিদের কাজ শেখানো শুরু করে দিয়েছি। নিজের ছেলে বিশ্বজিৎ এবং জ্যোতিকে হাতে ধরে এই শিল্প শিখিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

কটুমকুটুম শিল্প নিজের হাতে শিখছেন জ্যোতি সরকার। তার তৈরি আসবাব ঠাই পেয়েছে জলপাইগুড়ি জেলার বিভিন্ন সরকারি দফতর এবং বিলাসহুল রিসোর্টেও। জ্যোতির কথায়, কাটুমকুটুম শিল্পের চাহিদা অনেক সারা বিশ্বে। কিন্তু আমাদের এখানেই সেভাবে কেউ এই শিল্পের কদর করে না। রেডিমেড কিনতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে অনেকে। এই শিল্পকলার পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়াটা সময়সাপেক্ষ। এতে ধৈর্য দরকার। আমি এবং দাদা চেষ্টা করছি এই শিল্পকে আরও বেশি ছড়াতে। আশাকরি একদিন পারবোও।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।