চৈতালি নন্দী: চিন্তন নিউজ:১৭ই অক্টোবর:- এদেশে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয় ১৯২০ সালে পরাধীন ভারতবর্ষে। সেসময় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার মূলে গৌরবোজ্জ্বল নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব অনস্বীকার্য। মার্কসবাদী মতাদর্শের সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের পরিচয় ঘটে সেই সময়েই। ঠিক ঐ সময়টাই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিযুগ। শতবর্ষের আলোকে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ধারাবাহিক সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের ইতিহাস। ১৯২১/২২ সালে আমেদাবাদ অধিবেশনে কমিউনিস্টরাই প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুলেছিলেন।শুধু তাই নয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের বিলোপ ও আর্থসামাজিক পরিবর্তনের নির্দিষ্ট ও ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের উদ্যোগে কমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিক, কৃষক,ছাত্র সহ সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণে আতঙ্কিত ব্রিটিশ শাসকের কঠোর দমনপীড়নের শিকার হন কমিউনিস্টরা। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মামলাগুলি (পেশোয়ার, মীরাট) ছিল এই দমনের কদর্য রূপ। কমিউনিস্টদের প্রগতিশীল ধ্যানধারণার স্বপক্ষে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, ফ্যাসিবাদ বিরোধী জঙ্গি কার্যকলাপ দেশের যুবসমাজকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বীরত্বপূর্ণ আপোষহীন ভূমিকায় বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটে। সেই সময় ভারতও স্বাধীনতা লাভ করে।
পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সেনানীরা দীপান্তরে যাবার পূর্বেই অথবা কারাবাস কালে কমিউনিজম কে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আন্দামানের সেলুলার জেলের বন্দীদের বড় অংশ পরবর্তীকালে সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের শরিক হন। যদিও দেশের বিভেদকামী অশুভশক্তি বিভিন্ন সময়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কমিউনিস্টদের দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু কিছু তথ্য সামনে রাখলেই বিষয়টির সত্যতা সামনে আসে। ১) মীরাট যড়যন্ত্র মামলায় মুজাফফর আহমেদ কে ব্রিটিশ সরকার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও স্বাধীনতা উত্তর কালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ২) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের অন্যতম নায়ক গনেশ ঘোষ দীর্ঘ ১৬ বছর সেলুলার জেলে কারাবাসের পর সিপিআই এর এমপি ও এমএলএ হন। ৩) কল্পনা দত্ত, যিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম মুখ, ৬বছর দীপান্তর শেষে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।৪) সুবোধ রায়,চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কনিষ্ঠ সৈনিক, ১ বছর কারাবাস অন্তে সিপিআই এর আজীবন সদস্য। ৫) অম্বিকা চক্রবর্তী, চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ১৬ বছর কারাবাস শেষে সিপিআই এ যোগদান ও এমএলএ নির্বাচিত। ৬) হরেকৃষ্ণ কোঙার,৬ বছর আন্দামানে দীপান্তর শেষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ। ৭) লক্ষী সায়গল, আজাদ হিন্দ বাহিনীর ঝাঁসির রানী রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন, আমৃত্যু ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যা। ৮)পি সি জোশি, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় যাবজ্জীবন শেষে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম জিএস। ৯) ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ, ১৯৩৪-৪২ ব্রিটিশ সরকারের ওয়ান্টেড লিস্টে যৌবনের অর্ধেক সময় কাটিয়ে কেরালার প্রথম কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়াও ছিলেন শিব ভার্মা, শওকত উসমানী, জয়দেব কাপুর, অজয় ঘোষ, কিশোরী লাল, সতীশ পাকরাশী,অরুনা আসাফ আলি, বি টি রনদিভে। এঁরা ছাড়াও ছিলেন অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী যাঁরা স্বাধীনতা পরবর্তী কালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সরাসরি দেশসেবার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন।
অপরদিকে একবার ফিরে দেখা যাক আরএসএস এর ন্যক্কারজনক ভূমিকার দিকে। মাধব সাদাশিব গোলওয়ালকর, দ্বিতীয় স্বর সঙ্ঘ চালক, যিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াইয়ে শক্তি খরচ না করে মুসলমান ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন। ছিলেন দামোদর বিনায়ক সাভারকর, যিনি ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দিয়েছিলেন আর কোনো দিন স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবেন না বলে। ছিলেন নাথুরাম বিনায়ক গডসে, যিনি জাতির পিতা গান্ধীজির হত্যাকারী। অটলবিহারী বাজপেয়ীর নাম উঠে আসে ব্রিটিশদের রাজসাক্ষী হিসেবে, যিনি অসংখ্য বিপ্লবীকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ দের কাছে। ছিলেন বিজেপির প্রাণপুরুষ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যিনি ভারত ভাগের এক ঘৃন্য চক্রান্তকারী হিসেবে চিহ্নিত।
শতবর্ষের আলোকে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ব্যাখ্যা করতে গেলে উঠে আসে তাঁদের দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, আদর্শবাদ ও সাম্যবাদী মনোভাব কে সঙ্গে নিয়ে সব শ্রেণীর মানুষকে সঙ্গবদ্ধ করার ইতিহাস, সেলুলার জেলের
ফলক খুলে নিয়ে যাকে মুছে ফেলা যায় না।