কলমের খোঁচা

জীবনের প্রবহমানতা, মানুষের অবক্ষয় যিনি চলচ্চিত্র পরিচালনায় তুলে ধরেছেন তিনি ঋত্বিক ঘটক


মিতা দত্ত: চিন্তন নিউজ:৪ঠা নভেম্বর:- দাদা , আমি বাঁচতে চাই। ঋত্বিক ঘটকের “মেঘে ঢাকা তারা” সিনেমায় মূল চরিত্র নীতার এই আকুতি আমাদের যন্ত্রণাবিদ্ধ করেছে। এই যন্ত্রণায় আমরা অশ্রুসিক্ত হয়েছি।

তাঁর সমস্ত সৃ‌ষ্টি জুড়েই আমরা দেখতে পাই লড়াই । আর এই লড়াই হেরে যাওয়া নয়, পুনর্জাগরণ যা আমাদের প্রাণিত করে। তাঁর কথায়, ” একটি ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের দেখা হলো, এ ধরনের পুতুপুতু গল্পে আমার রুচি নেই। আমি আপনাদের ঘা দেবো” তাঁর প্রত্যেকটি কাজ আমাদের মনোভূমিকে আন্দোলিত করেছে। আমরা উজ্জীবিত হয়েছি। তিনি তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে বামপন্থার বার্তা দিয়ে গেছেন। বামপন্থা মানে লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিশা কাটিয়ে সুপ্রভাত প্রতিষ্ঠা। তিনি আমাদের সেই পথই দেখিয়েছেন।

ইন্দুমালা দেবী ও সুরেশচন্দ্র ঘটকের কনিষ্ঠতম সন্তান ঋত্বিকের জন্মগ্রহণ করেন আজকের দিনে অভিভক্ত পূর্ববঙ্গের রাজশাহী জেলায়। রাজশাহী কলেজ থেকে আই,এ পাশ করেন১৯৪৬ খৃষ্টাব্দে। তারপরই শুরু হয় মন্বন্তর ও দেশভাগের সেই করুণ অধ্যায়। এইসময় তাঁর পরিবার চলে আসে এপার বাংলায় বহরমপুরে। বহরমপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি,এ পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তিনি সেই পাঠ সম্পূর্ণ করেননি। তিনি সৃ‌ষ্টির আনন্দে মেতে ওঠেন।

১৯৫১ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দেন। এইসময় বিশ্ববিখ্যাত ব্রেশট ও নিকোলাই গোগোলের রচলাবলী বাংলায় অনুবাদ করেন। চলতে থাকে তাঁর নাটক রচনা। মন দেন সিনেমা পরিচালনার কাজে। সিনেমায় উঠে আসে উদ্বাস্তু জনগণের অস্তিত্বের সংকট ও সেই সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের কথা। প্রতিটি সৃ‌ষ্টিতে তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন। মেঘে ঢাকা তারা , কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা – এই তিনটি সিনেমাকে একসঙ্গে তিনি ট্রিলজি বলেন। এই তিনটি সিনেমায় যন্ত্রণাকাতর শ্রমজীবী মানুষের কথা একেঁছেন যা সিনেমার জগতে ভিন্ন মাত্রা এনে দে। মানুষকে মানুষ নিয়ে ভাবায়।

১৯৬৫ সালে স্বল্পসময়ের জন্য পুণেতে বসবাস করেন এই সময় তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং প্রফেসরের কাজ করেন।

পরবর্তীতে তাঁর আর একটি অনবদ্য কাজ অদ্বৈত মল্লবর্মনের লেখা ,তিতাস একটি নদীর নাম রচনাটিকে সিনেমায় রূপ দেওয়া ।এখন তিতাস একটি নায়িকা নদী। এই সিনেমায় উঠে এসেছে নদীর কষ্টের কথা। তিনি যেন প্রকৃতিপ্রেমী। তাই তিতাসকে তিনি শুকিয়ে যেতে দেন নি। তাঁকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। ।

এইভাবেই তাঁর প্রত্যেকটি সৃ‌ষ্টি মৌলিক ।তাঁর শেষ সিনেমা, যুক্তি,তক্কো, গল্প – একদিকে আত্মজীবনীর ছাপ, অন্যদিকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের জল্লাদদের দ্বারা অত্যাচারিত নারীর সকরুণ কাহিনী উঠে এসেছে ও তারও জীবনের গতিপথ পাল্টে দিয়েছেন। উঠে এসেছে সমাজবিপ্লবের কথা।

এছাড়াও রয়েছে তাঁর। ডকুমেন্টারি ফিল্ম যার মধ্যে যেমন রয়েছে পুরুলিয়ার ছোঁ নাচ তেমনি রয়েছে লেনিন ।এই ব্যক্তিত্ব যে নানাবিধ তাঁর সৃ‌ষ্টির জন্য নানাবিধ পুরষ্কারে সন্মানিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো পুরষ্কারই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়। তিনি কালোত্তীর্ণ ছিলেন

জীবনের শেষদিকে হয়তো এই আশাবাদী এই মানুষটি আধা সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পিষ্ট মানুষের জীবন যন্ত্র‌ণা মেনে নিতে পারছিলেননা তাই জীবন থেকে পালাতে নেশার আশ্রয় নিয়েছিলাম। এই নেশায় তাঁর জীবনদীপ নেভার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আমরা মানে তাঁর চিন্তার শরিকরা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবো। জন্মদিনে এটাই আমাদের অঙ্গীকার।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।