সীমা বিশ্বাস: চিন্তন নিউজ:১লা জুন:– “১ লা জুন আন্তর্জাতিক শিশু দিবস”_ ১৯৫১ সালে বিশ্ব নারী সংঘ প্রতি বৎসর ১লা জুন তারিখটিকে ‘ ‘আন্তর্জাতিক শিশু দিবস’ হিসেবে ঘোষনা করে এবং সেই থেকে প্রতি বছর বিশ্ব নারী সংঘের আহ্বানে বিভিন্ন দেশে” আন্তর্জাতিক শিশু দিবস” পালিত হয়ে আসছে।১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে ভিয়েনা শহরে বিশ্বনারী সংঘ আন্তর্জাতিক শিশু রক্ষা সন্মেলন অনুষ্ঠিত করে। এই সন্মেলনের মূল বক্তব্য ছিল-শান্তিপূর্ণ পৃথিবীতে শিশু দের বাঁচার অধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকারকে সুরক্ষিত করা।এই সন্মেলনে ভারতবর্ষ থেকে ১৫ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত শিশু চিকিৎসক ডাঃ কে সি চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। এই সন্মেলনের পর ১ লা জুন পৃথিবীর ৬০ টি দেশে ব্যাপক ভাবে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস পালিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশুদের সর্বনাশ হয়েছে সবচেয়ে বেশি।লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবন নাশ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শিশু চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে গেছে। অনাথ হয়ে গেছে। একমাত্র গ্ৰীসেই সরকারি হিসাবে ৭৫০০০ শিশু পিতৃমাতৃহীন হয়েছিল।তিন লক্ষ গৃহহীন অনাথ হয়েছিল। ৩০,০০০ শিশু বন্দী হয়েছিল। এইসব শিশুদের সাহায্য কল্পে জাতিসংঘ থেকে একটি অর্থভাণ্ডার খোলা হয়।বিশ্ব নারী সংঘ অগ্ৰণী হয়ে সেই ভান্ডারে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে দেয় এবং বিশ্বের দেশে দেশে শিশু রক্ষার আন্দোলন গড়ে তোলে।
১৯৯০ সাল ৩০ শেষ সেপ্টেম্বর ও১লা অক্টোবর দু’দিন ব্যাপী বিশ্ব শিশু সন্মেলনে আয়োজিত হয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দফতরে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিশুদের নানা সমস্যাবলী নিয়ে ভাবনার দিগন্ত প্রসারিত করাই ছিল এই সন্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা র জন্য নানা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল এই সন্মেলনে। অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন ভারত সহ ১৫২টির বেশি দেশ। বিশ্ব ব্যাপী দারিদ্র্যতার কথাৃ তুলেছেন তারা, শিশু মৃত্যুর ব্যাপকতা নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছেন উদ্বেগ দেখিয়েছেন অবৈধ শিশু শ্রমিক প্রথার ও শিশু নিরক্ষরতার জন্য।
গোটা বিশ্বে আজ কোটি কোটি শিশু প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে করে ক্লান্ত।যুদ্ধ ও প্রকৃতির ধ্বংস লীলার শিকার আনবিক ও রাসায়নিক নানা বিকিরণ পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। তার উপর রয়েছে অসম সমাজ ব্যবস্থা ও শ্রেণীবৈষম্য। জন্মাবার পর মুহূর্তেই অবহেলা অনাদর তাদের প্রাপ্য। তৃতীয় বিশ্বের দেশ সম্পর্কে এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। সন্মেলনে গৃহীত ঘোষণা পত্রে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রায় দশ কোটির ও বেশি শিশু আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে নানা অর্থকরী কাজে যুক্ত। এটা তাদের স্বাস্থ্য, লেখাপড়া এবং পূর্ণ বিকাশের পক্ষে খুবই ক্ষতি কারক। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ভারতের শিশু দের সম্পর্কে একথা অতীব সত্যি। ভয়াবহ দারিদ্র্যতা, সঠিক পরিকল্পনার অভাব, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব শিশুর ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। অথচ এই শিশুরাই আগামী দিনে জাতির ভবিষ্যৎ। দুরদর্শনে শহরের মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের দেখে অনুমান করা যাবে না এদেশের চিত্রটা কেমন।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায় ভারতে শিশু শ্রমের হার বেশি, শিশুরা অপুষ্টি জনিত রোগে বেশি ভোগে। শিশু মৃত্যুর হার বেশি।হাম, ডায়েরিয়া, নিউমোনিয়া,ধুংরি কাসি, ক্ষয়রোগ দরিদ্র পরিবারের নিত্য সঙ্গী। ইদানিং ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গু জ্বরে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
অপরদিকে সাক্ষরতার প্রস্নে শিশু সাক্ষরতার হার অতি নিম্নে। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা বর্ষে সার্ক দেশগুলো দাবি তুলেছে শিশু কন্যা দের জন্য শিক্ষার আলো চাই। কেননা ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে নারীমুক্তি আন্দোলন চলা স্বত্ত্বেও নারী সাক্ষরতার হার পুরুষ সাক্ষরতার চেয়ে অনেক কম। পরিবারের কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থান করে মা কিংবা বৌ হিসেবে তারা পরবর্তী প্রজন্ম কে নূতন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয় শিক্ষার অভাবে। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা বর্ষে তাই শিশু কন্যা দের কথা বেশি করে মনে রাখতে হবে। দারিদ্র সীমার নিচে বাস বাস করা পরিবারের শিশুদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে সাংঘাতিক ভাবে। এদের অপরাধ প্রবণ হবার একটা প্রধান কারণ হলো নিরক্ষরতা।
এছাড়া উল্লেখযোগ্য যে ভারতবর্ষে সরকার শিশুর অপুষ্টি দূর করা এবং স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধির প্রশ্নে যে “শিশু সংহতি বিকাশ প্রকল্প”চালু করেছিল তা কিছু টা অপুষ্টি হীনতা এবং নিরক্ষরতা দূর করতে সক্ষম হয়েছিল বিদ্যালয় গুলিতে মধ্যাহ্ন ভোজনের ব্যবস্থা সেই সঙ্গে অঙ্গন ওয়াড়ি কর্মীদের শিশু কল্যাণমুলক প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার ফলে অনেকাংশে শিশু সুরক্ষা র কাজটা এগিয়ে ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এই প্রকল্প গুলোতে সরকার প্রয়োজন সাপেক্ষে বাজেট বরাদ্দ না করার ফলে শিশু দের বিকাশ তেমন ভাবে ঘটেনি।তাই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ভারতবর্ষে শিশু মৃত্যুর হার বেশি,কম ওজন জন্মানো শিশুর সংখ্যা বেশি।স্বাক্ষরতার হার আশানুরূপ না। আরেকদিকে শিশু শ্রমের অভিশাপ আমাদের দেশে এত ই সাধারণ ঘটনা যে সাধারণ মানুষ এই ব্যাপারটি উপেক্ষা করে যান।১৯৬০ সাল থেকে ইউনিসেফ, ইউনেস্কো,আই এল ও এই সংস্থাগুলো শিশু শ্রমের অবসানের চেষ্টা করে আসছে। ইউনাইটেড নেশনস এবং সাধারণ সভা ১৯৫৯ সালে একটি সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে এবং শিশু শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে একটি নীতি ঘোষণা ও করে। কিন্তু বাস্তবে কাজ শুরু হয় ১৯৭৯তে। সেই বছরটি আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ হিসেবে ঘোষিত হয়। সংবিধান মতে কিংবা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার প্রচলিত ধারা অনুসারে ১৪ বছরের অনুর্ধ শিশুদের সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে,ক্ষেতে, খনিতে কাজ করানোর নিয়ম না থাকলেও আমরা এই সব জায়গায় শিশু দের কাজ করতে দেখতে পাই।
শিশু শ্রমিক প্রতি বছরই সব দেশই বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর মধ্যে ভারতবর্ষে ও আছে। ভারতে উত্তর প্রদেশের কার্পেট শিল্পে, রাজস্থানে জয়পুরে পাথর পালিশ করার কাজে, ফিরোজাবাদে কাঁচ তৈরীর কাজে,সুরাটে হীরে প্রস্তুত করার শিল্পে, এছাড়াও নির্মাণ কাজে , হোটেল-রেস্তোরায়, ছোট ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানে দোকানে শিশু শ্রমিক প্রচুর সংখ্যায় নিয়োগ করা হয়। বিড়ি তৈরির কাজে তো ১৪ বছরের অনুর্ধ শিশু শ্রমিক রাখার জন্য বিখ্যাত। কার্পেট শিল্পে মাত্র ৭ বছর বয়সে কাজে যোগ দেয় এবং প্রথম তিন বছর এরা কোনো পারিশ্রমিক পায় না। অসংখ্য বিপদজনক ইউনিটে তাদের কাজ করানো হয়।বিশেষভাবে উল্লেখনীয় যে কর্মস্থলে কন্যা শিশুরা যৌন নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়। কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ন্যায্য মজুরি এবং গ্ৰুপ ইন্সুরেন্সের এর সুবিধা মালিকপক্ষ তাদের দেয় না।
সংবিধানে যদিও বা শিশু শ্রমিক নিয়োগ রোধ করার কথা বলা আছে ঠিকই কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে কতটুকু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এটাই আসল প্রশ্ন। মূল বিষয় বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের দিনে এত দারিদ্র্যতা, নিরক্ষরতার মাঝে শিশু শ্রমিককে একেবারে বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু আমারা এই অবস্থার মধ্যে ও একটু ভালো ভাবে বাঁচবার জন্য ব্যবস্থা করতে পারি। তাদের কাজের ঘন্টা বয়সানুসারে কমিয়ে আনতে পারি।
ন্যায্য মজুরি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আদায় করে দিতে হবে, তাদের কাজের জায়গার কাছাকাছি শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং এদের জন্যে পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে দূরে রেখে তাদের মানসিক বিকাশের ও সুযোগ দিতে হবে। উল্লেখযোগ্য যে ১৯৯১সনের নতুন অর্থনীতি , বেসরকারীকরণ ও উদারীকরণের নীতি চালু হবার পর থেকেই শ্রমিক সুরক্ষমূলক আইন শিথিল হতে সুরু করে। সামগ্রিক ভাবে তার প্রভাব শিশু শ্রমিকদের উপর পড়ে। আরো দুর্ভাগ্য যে ২০১৪ সনে দক্ষিনপন্থী, সাম্প্রদায়িক, কর্পোরেট ও বৃহৎ ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষাকারী সরকার ক্ষমতায় আসার পর জনকল্যাণমুলক আইন শিথিল করা হয়। ফলে শিশুদের বিকাশের পক্ষে, তাদের সুন্দর শৈশব থেকে পূর্ণ জীবন গড়ার পথ বাধাগ্ৰস্ত হয়। বর্তমানে কোরোনা সংক্রমণ কালে কাজ হারান বহু মানুষ। তারই কারণে কমেছে দেহে পুষ্টির যোগান।রাষ্ট্রসংঘ জানাচ্ছে এই সময়ে অনাহারে, অর্ধাহারে পুষ্টির অভাবে মৃত্যু হয়েছে কয়েক হাজার শিশুর।
যে শিশুরা আগামী দিনের জাতির ভবিষ্যৎ তাদের কথা মাথায় রেখে সমাজ সচেতনশীল মানুষকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। মানবিকতা তার সাথে সচেতনতার সাথে জনমত গড়ে তুলতে হবে। ১লা জুন আন্তর্জাতিক শিশু দিবস দেশে দেশে পালিত হবে। শিশুর ভবিষ্যৎ রক্ষায় সকলে অঙ্গীকারবদ্ধ হবে।