উত্তম দে: চিন্তন নিউজ:০৮/০৮/২০২৪:- স্বপ্নের কারিগরের মৃত্যু। যে মানুষটা স্বপ্ন দেখতেন বাংলা মাথা উঁচু করে বাঁচবে,এরাজ্যের বেকার যুবরা এরাজ্যেই কাজ পাবে — স্বপ্নের সেই কারিগর, কমিউনিস্ট নেতা, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য আজ সকালে পাম এভিনিউ এর দু কামরার বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রয়াণকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। আজ তাঁর বাসভবন হয়ে পিস ওয়ার্ল্ডে তাঁকে রাখা হবে। কাল সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তর মুজফ্ফর আহমেদ ভবনে অনুরাগী ও পার্টি কর্মীদের শেষ দেখা ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আনা হবে। সেখান থেকে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর দেহ কলকাতা এন আর এস হাসপাতালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চার জন্য মরনোত্তর দান করা হবে। প্রয়ানকালে রেখে গেলেন স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য্য,একমাত্র কন্যা সুচেতনা সহ অগুনিত দলীয় নেতা,কর্মী,সমর্থক,অসংখ্য অনুরাগীদের।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতৃষ্পুত্র বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য ১লা মার্চ, ১৯৪৪ সালে উত্তর কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন। ১৯৬১সালে শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে প্রেসিডেন্সী কলেজে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এই সময় তিনি বাম ছাত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। খাদ্য আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৮ সালে গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন ( DYF ) প্রতিষ্ঠা হলে তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। এই সময় প্রয়াত দীনেশ মজুমদার ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে রাজ্যজুড়ে DYF এর পতাকাতলে রাজ্যের যুবদের আন্দোলনের ঢেউ ওঠে।১৯৭১ সালে তিনি সিপিআই(এম) দলের রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দলের রাজ্য সম্পাদকমন্ডলী ও কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরোর সদস্য হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭৭ সালে কাশিপুর কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী হন। ১৯৮৭ থেকে তিনি পরপর পাঁচবার যাদবপুর থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। অসুস্থতার কারণে ২০০০ সালের ৬ই নভেম্বর জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নিলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ওপর এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তাঁর নেতৃত্বেই ২০০১ ও ২০০৬ সালে বামফ্রন্ট বিপুল আসনে জয়লাভ করে।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবার পর তিনি রাজ্যের শিল্পায়নের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেন।

তাঁর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রের প্রসারে ২০০৩ সালে নতুন আই টি নীতি প্রনয়ণ করে। এই সময় রাজ্যের তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের বিকাশের হার ৭০% এ পৌঁছে যায় এবং তার জন্যই উইপ্রোর কর্ণধার আজিম প্রেমডী বুদ্বদেব ভট্টাচার্যকে দেশের সবচেয়ে দক্ষ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেন। শুধুমাত্র তিনিই নন, তাঁর নেতৃত্বে চলা বামফ্রন্ট সরকারের আই টি সেক্টর নিয়ে সুষ্পষ্ট নীতি, পরিকল্পনা, রূপায়ন দেখে ইনফোসিসের তৎকালীন ফিনান্স ডিরেক্টর টি ভি মোহনদাস পাই বলেন, একুশ শতকের এ দেশের নবজাগরন কলকাতার হাত ধরেই হবে।
শুধুমাত্র আই টি সেক্টরই নয়, রাজ্যের কর্মসংস্থানের স্বার্থে শিল্পায়নের জন্য তিনি দেশ-বিদেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্প উদ্যোগীদের এরাজ্যে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানান। তার সেই আহ্বানে বহু শিল্পপতি এরাজ্যে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন। বছর বছর করের টাকায় নামকে ওয়াস্তে শিল্প সম্মেলনের পথে না হেঁটে তিনি শিল্পায়নকে বাস্তব রূপ দিতে সিঙুর,নন্দীগ্রাম,শালবনী সহ বহু জায়গায় শিল্প উদ্যোগীদের কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করান। শালবনীতে জিন্দালদের ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস করেন, সিঙুরে টাটা গোষ্ঠীর ছোট গাড়ির কারখানার কাজ অনেকটাই সম্পন্ন হয়,এমনকি কর্মীদের প্রশিক্ষণের কাজও শুরু হয়। কিন্তু, বামফ্রন্ট সরকারের উন্নয়ণমুখী পদক্ষেপ, বেকারদের স্বাবলম্বী করবার প্রয়াসের বিরুদ্ধে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। যেনতেন প্রকারে শিল্প প্রতিষ্ঠাকে বানচাল করতে তৃণমুল কংগ্রেস,কংগ্রেস,বিজেপি,
অতিবাম,এমনকি খুনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী মাওবাদীদের নিয়ে তৈরি হয় শিল্পবিরোধী রামধনু জোট। এর সাথে যুক্ত হন কিছু তথাকথিত সুশীল। শুরু হয় একে একে বাম নেতা,কর্মী খুন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট।
আজ সেইসব ষড়যন্ত্রের কথা ক্রমশ প্রকাশ্যে আসছে। শালবনীতে ইস্পাত কারখানা শিলান্যাস করে ফেরার পথে মাইন বিষ্ফোরণ করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। এই অস্থিরতার মধ্যে তিনি দমনমুলক পথে না হেঁটে রাজ্যের স্বার্থে বিনম্রভাবে বিরোধীদের কাছে অনুরোধ করেন, আসুন রাজ্যের ছেলে মেয়েদের কথা চিন্তা করে আমরা সকলে মিলে একটা সমাধানের পথ বের করি। দয়া করে শিল্প সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করবেন না। কিন্তু সে অনুরোধ কেউই কর্ণপাত করে নি। একে একে শিল্প উদ্যোগীরা রাজ্য থেকে হাত গুটোতে বাধ্য হন। রতন টাটা ” মমতা আমাকে পেছন থেকে ট্রিগার টিপে দিল ” বলে চলে যায় গুজরাটের সানন্দে। শিল্প তাড়িয়ে,বেকারদের স্বপ্ন ভঙ্গ করে বিরোধীরা বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। একজন নিপাট সজ্জন, কলঙ্কহীন,প্রকৃত অর্থেই সৎ,রুচিবান,সংস্কৃতিবান ব্যক্তির ছবিতে পর্যন্ত কালি লেপা হয়। এ রাজ্যে শিল্পায়ন করতে না পারার যন্থ্রমা বুদ্বদেব ভট্টাচার্য্যকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কুরে কুরে খেয়েছে।
একজন প্রকৃত কমিউনিস্টের জীবন কেমন হওয়া উচিত,তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সহজ, সরল জীবন যাপন দেখলেই অনুমান করা যায়। আজ যখন মন্ত্রী থেকে ছোট,মাঝারি নেতাদের ঘর থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হচ্ছে, বিলাসবহুল গাড়ি, নামে-বেনামে হিসাব বর্হিভুত স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির হদিশ মিলছে, তখন প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা প্রয়াত প্রমোদ দাশগুপ্তের অত্যন্ত প্রিয় এই কমিউনিস্ট নেতা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পাম এভিনিউ এর দু’কামরার ঘরেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। একটা সাধারন খাট আর ঘর ভর্তি বইয়ের পসাড়, দেওয়ালে মার্কস, লেনিন, চে গুয়েভারার পাশাপাশি মা,বাবার ছবি ও সুকান্ত, রবীন্দ্রনাথ, পিট সিগারের ছবি।
শয্যাশায়ী অবস্থাতেও নিয়ম করে রবীন্দ্র সংগীত শুনতেন, স্ত্রী মীরাদেবীর দায়িত্ব ছিলো সংবাদপত্র পাঠ করে ওনাকে রাজ্য, দেশ, আন্তর্জাতিক সংবাদ শোনানো। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি বহু বিদেশী ঊপন্যাস, প্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন। লিখেছেন নাটক, প্রবন্ধ। যে কোন জনসভায় তাঁর বক্তব্য শেষে শ্রোতাদের কাছে তাঁর কন্ঠে রবীন্দ্র, সুকান্তর কবিতা শোনা ছিল বাড়তি পাওনা।
সব শেষ। সাধের নন্দন হয়ত শোকে মুহ্যমান। দলের রাজ্য দপ্তর, অগুনিত দলীয় কর্মী, সমর্থক, সাধারণ মানুষকে চোখের জলে ভাসিয়ে কাল কলকাতা এন আর এসের মেডিক্যাল ছাত্র ছাত্রীদের গবেষনার জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দেহ দান করা হবে। চোখের কর্নিয়া ইতিমধ্যেই দান করা হয়েছে। কোন অন্ধকার চোখ আলো দেখবে। এ তো মৃত্যু নয়। মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজ,জীবন বোধের মধ্যে চীরকাল। এমন মানুষের মৃত্যু হয় না।
