কলমের খোঁচা

৷৷ উপস্থিত ৷৷


গোপাল চাকী,নিজস্ব প্রতিবেদন: চিন্তন নিউজ:১৪ই মে:– একটা ফোন, একটা খবর আজ হঠাৎ ২৮ বছর পিছিয়ে নিয়ে গেল ! সকালে একজন ডাক্তারবাবুর সাথে এপয়েন্টমেন্ট ছিল আমাদের কোভিড যোদ্ধাদের জন্য, তাড়াহুড়ো করছি অফিস বন্ধ করে বেরোবো, তখনই বাল্যবন্ধু শুভ ফোনে খবরটা দিল ৷ খুব আনমনেই শুনলাম, শুনেই বেড়িয়ে পরলাম নিজের নির্ধারিত কাজে ৷ রাস্তায় গাড়ি খুবই কম, বেশ ফাঁকা আমার শহরটা ৷ একমনে স্কুটি চালাতে চালাতে কখন যেন পৌছে গেলাম নিজের শৈশবে !

কেওটা কলোনি প্রাথমিক স্কুল থেকে ফোর পাশ করে সবে ব্যান্ডেল সেন্ট জন্সে ফাইভে ভর্তি হয়েছি ৷ ভেতরে ভেতরে বেশ নার্ভাস, এত বড় স্কুল, এত ভালো ভালো স্কুল থেকে আসা সহপাঠীরা, এত নামকরা সব শিক্ষকরা, এত নিয়মানুবর্তীতা ! তারপর হঠাৎ করেই নিজের পদবীটার কারনে বেশ কিছুটা স্বাভাবিক হয় পরিবেশটা ৷ কোনো কোনো স্যার মজা করে প্রফুল্ল চাকীর কথা বলে পরিচয়টা সারলো, কেউ কেউ আবার অন্য কারনে ৷ “তুই হরিশঙ্করের ভাই?” এই প্রশ্নে যাদের সাথে পরিচয় হল তাদের মধ্যে অন্যতম সুব্রত স্যার ৷ সুব্রত ঘোষ ৷

কখনও হিরো সাইকেল, কখনও রাজদূত এক্সেলটি নিয়ে স্কুলে আসতেন অসাধারন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুব্রত স্যার ৷ ওনার ভূগোল পড়ানোর সুনাম এশহরে প্রায় সকলেই জানতো ৷ আমার মত চূড়ান্ত অমনোযোগী ছাত্রও ওনার পড়ানো, বলা ভালো বোঝানোর পদ্ধতিতে মুগ্ধ হয়ে যেত ৷ কালে ক্রমে অদ্ভুত এক ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল স্যারের সাথে ৷ আমাদের সহপাঠীরা সেটা সকলেই প্রায় জানতো ৷ আমি স্কুল জীবনে অধিক পরিচিত ছিলাম শয়তানির জন্য ৷ আমার এধরনের কার্য্যকলাপ দেখে স্কুলে নতুন চাকরি পাওয়া একজন শিক্ষক একদিন স্টাফ রুমে আফশোষ করে বলে ফেলেন,” এ ছেলেটা বোধহয় মাধ্যমিক পাশ করতে পারবে না” ৷ দোতলার বারান্দার কোনায় সুব্রত স্যার ডেকে বললেন, “শোন, আমি কিন্তু বলেছি ও স্টার পাবে ৷ আমাদের সন্মানটা রাখিস” ৷ না আমি স্টার পাইনি ৷ তিন নম্বর কম পেয়েছিলাম ৷ সাইন্স গ্রুপের সাথে সুব্রত স্যারের সাবজেক্টেও লেটার পেয়েছিলাম ৷ যখনই বেশি দুষ্টুমি করতাম তখনই বলত, “এই হাতটা দেখেছিস ৷ এই হাতেই তুই খুন হবি” ৷ কত কত স্মৃতি আজ মনে ভীর করে আসছে ! স্কুল ছাড়ার পরও বহুবার রাস্তায় দেখা হয়েছে, ওনার কাজিডাঙার বাড়িতেও বহুবার গেছি ৷ অদ্ভুত এক আপনত্বে ভরা ছিল ওনার ব্যবহার ৷ ব্যক্তিত্বও ছিল তেমনই , দৃঢ়তা ছিল চূড়ান্ত কিন্তু অহংকার ছিলনা বিন্দুমাত্র ৷ নিজের গোটা চাকরি জীবনে কখনও স্কুল কামাই করেন নি উনি ৷ কখনও না, একদিনের জন্যও অনুপস্থিত ছিলেন না ৷ উনি যখন ক্লাস টিচার ছিলেন তখন এবসেন্ট নোট লিখতে রীতিমত অপ্রস্তুত হতাম ৷ কি কারন লিখব ! যিনি নিজে কখনও কোনো কারনে অনুপস্থিত হননি তাকে কি কারন দেখাব ! আর আজ আচমকা তিনিই চিরতরে অনুপস্থিত হয়ে গেলেন !

কয়েক প্রজন্ম যারা ওনার সময়কালে সেন্ট জন্সে পড়েছেন, তাদের সকলের পক্ষ থেকে নির্দ্ধিধায় বলতে পারি আমাদের শ্রদ্ধা ও সুখ স্মৃতিতে আপনি চিরকাল উপস্থিত থাকবেন স্যার ৷


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।