কলমের খোঁচা

মিত্রের প্রয়ান দিবসে স্মরণে নাট্যকার এবং কবি দীনবন্ধু মিত্র


রত্না দাস: চিন্তন নিউজ:১লা নভেম্বর:- উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। তাঁর প্রথম প্রকাশিত নাটক নীলদর্পণ প্রকাশিত হয় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে। এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং প্রকাশক জেমস লঙের জরিমানা ও কারাদণ্ড হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এটিই প্রথম বাংলা নাটক যা ইংরেজিতে অনূদিত হয়। নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে প্রেরিত হয়। স্বদেশে ও বিদেশে নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ফলে সরকার ইন্ডিগো কমিশন বা নীল কমিশন বসাতে বাধ্য হন। আইন করে নীলকরদের বর্বরতা বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়। এর পরে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় নাটক নবীন তপস্বিনী। দীনবন্ধুর দুটি উৎকৃষ্ট প্রহসন হল সধবার একাদশী ও বিয়ে পাগলা বুড়ো। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অপর এক প্রহসন জামাই বারিক প্রকাশিত হয়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর সর্বশেষ নাটক কমলে কামিনী। নাটক ছাড়াও দুখানি কাব্যগ্রন্থও দীনবন্ধু রচনা করেছিলেন – দ্বাদশ কবিতা (১৮৭২) ও সুরধুনী কাব্য (প্রথম ভাগ– ১৮৭১ ও দ্বিতীয় ভাগ – ১৮৭৬)। দীনবন্ধু মিত্র মাইকেল প্রবর্তিত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক নাট্যরচনার পথে না গিয়ে বাস্তবধর্মী সামাজিক নাট্যরচনায় মনোনিবেশ করেন। এই ধারায় তিনিই হয়ে ওঠেন পরবর্তীকালের নাট্যকারদের আদর্শস্থানীয়।
জন্ম

দীনবন্ধু মিত্রের জন্ম জন্ম ১৮৩০সালে নদিয়া জেলার চৌবেরিয়ায়। পিতা কালাচাঁদ মিত্র। দীনবন্ধুর পিতৃদত্ত নাম ছিল গন্ধর্ব নারায়ণ। দরিদ্র পরিবারে জাত দীনবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রাম্য পাঠশালায়। সেখানে কিছুদিন পাঠগ্রহণের পর তাঁর পিতা তাঁকে জমিদারের সেরেস্তার কাজে নিযুক্ত করে দেন। কিন্তু বিদ্যোৎসাহী দীনবন্ধু কলকাতায় পালিয়ে আসেন এবং পিতৃব্যের গৃহে বাসন মেজে লেখাপড়া চালিয়ে যান। এই সময়েই দীনবন্ধু নাম গ্রহণ করে জেমস লঙের অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। পরে কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল (বর্তমানে হেয়ার স্কুল) থেকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে স্কুলের শেষ পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করে হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৫১ সালে আবার উচ্চতর পরীক্ষায় বৃত্তিলাভ করেন এবং ১৮৫২ সালে তৃতীয় শ্রেণী থেকে সিনিয়র বৃত্তিলাভ করেন। প্রত্যেক পরীক্ষায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনিই সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছিলেন। এরপর সম্ভবত কোথাও শিক্ষকতা করেছিলেন দীনবন্ধু, কারণ ১৮৫৩ সালে তিনি টিচারশিপ একজামিনেশনে কৃতকার্য হয়েছিলেন। কলেজের সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পটনায় পোস্টমাস্টার নিযুক্ত হন। ক্রমে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং তিনি ওড়িশা, নদিয়া ও ঢাকা বিভাগে এবং পরে কলকাতায় সুপারিনটেন্ডেন্ট পোস্টমাস্টার নিযুক্ত হন। লুসাই যুদ্ধের সময় ডাকবিভাগের কাজে তিনি কাছাড়ে প্রেরিত হন। এই সময় তাঁর তদারকি কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে সরকার তাঁকে রায়বাহাদুর উপাধি দান করেন। যদিও ডাকবিভাগের উচ্চস্তরের কর্মচারী হয়েও উপযুক্ত বেতন তিনি পাননি। বরং অতিরিক্ত পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানিজনিত কারণে মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
নাটক নীলদর্পণ- স্বাদেশিকতা, নীল বিদ্রোহ ও সমসাময়িক বাংলার সমাজব্যবস্থার সঙ্গে এই নাটকের যোগাযোগ অত্যন্ত গভীর। এই নাটকটি তিনি রচনা করেছিলেন নীলকর- বিষধর- দংশন- কাতর- প্রজানিকর- ক্ষেমঙ্করেণ- কেনচিৎ- পথিক ছদ্মনামে। যদিও এই নাটকই তাঁকে খ্যাতি ও সম্মানের চূড়ান্ত শীর্ষে উন্নীত করে। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘নীলদর্পণ’ নাটক প্রকাশিত হলে এবং এর ইংরেজি অনুবাদ প্রচারিত হলে একদিনেই এ নাটক বাঙালিমহলে যতটা প্রশংসিত হয়েছিল, শ্বেতাঙ্গমহলে ঠিক ততটাই ঘৃণিত হয়েছিল। এই নাটক অবলম্বন করে বাঙালির স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সূচনা, এই নাটক সম্বন্ধে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও রায়তদের মধ্যে মৈত্রীবন্ধন স্থাপিত হয়, এর মধ্যে দিয়েই শ্বেতাঙ্গ নীলকরদের বর্বর চরিত্র উদ্ঘাটিত হয়। মনে করা হয়ে থাকে, নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তবে আধুনিক গবেষকগণ এই বিষয়ে একমত নন। এই অনুবাদ Nil Durpan, or The Indigo Planting Mirror নামে প্রকাশ করেছিলেন রেভারেন্ড জেমস লঙ। এই অনুবাদ প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং জেমস লঙের জরিমানা ও কারাদণ্ড হয়। জরিমানার টাকা আদালতেই দিয়ে দেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এটিই প্রথম বাংলা নাটক যা ইংরেজিতে অনূদিত হয়।
নীলদর্পণ নাটকের মূল উপজীব্য বিষয় হল বাঙালি কৃষক ও ভদ্রলোক শ্রেণীর প্রতি নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের কাহিনী। কিভাবে সম্পন্ন কৃষক গোলকমাধবের পরিবার নীলকর অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে গেল এবং সাধুচরণের কন্যা ক্ষেত্রমণির মৃত্যু হল, তার এক মর্মস্পর্শী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এই নাটকে। তোরাপ চরিত্রটি এই নাটকের অত্যন্ত শক্তিশালী এক চরিত্র; বাংলা সাহিত্যে এর তুলনা খুব কমই আছে। এই নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য আঞ্চলিক ভাষার সাবলীল প্রয়োগ। কর্মসূত্রে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় যে দক্ষতা দীনবন্ধু আয়ত্ত করেছিলেন, তারই এক ঝলক দেখা মেলে এই নাটকের জীবন্ত চরিত্রচিত্রণে।

নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে প্রেরিত হয়। স্বদেশে ও বিদেশে নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ফলে সরকার ইন্ডিগো কমিশন বা নীল কমিশন বসাতে বাধ্য হন। আইন করে নীলকরদের বর্বরতা বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পরবর্তীকালে এই নাটকের সঙ্গে স্টো-এর আঙ্কল টমস কেবিন গ্রন্থের তুলনা করেছিলেন। তা থেকেই বোঝা যায়, সেই সময়কার বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সমাজজীবনে এই নাটক কি গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। সমাজের তৃণমূল স্তরের মানুষজনের জীবনকথা এমনই স্বার্থক ও গভীরভাবে নীলদর্পণ নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে যে অনেকেই এই নাটককে বাংলার প্রথম গণনাটক হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। আবার বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলে এই নাটকই প্রথম জাতির জীবনে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। নাট্যকার, কবি, দীনবন্ধু মিত্র১৮৭৩ সালের ১লা নভেম্বর,মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে প্রয়াত হন। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধায় স্মরণ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।