কলমের খোঁচা

নেতাজীর স্বদেশ ভাবনা।


চিন্তন নিউজ, বিশেষ প্রতিবেদন, কল্পনা গুপ্ত, ২৩ জানুয়ারী, ২০২২ :- সুভাষচন্দ্র বসু’র ১২৬ তম জন্মদিন । যিনি অমর তিনি মৃত্যুহীন, তাঁর প্রয়ান দিবস নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক অনন্য নজির। কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন ১৯৪৫ সালে ১৮ আগষ্ট তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে। ১৪ ই সেপ্টেম্বর এক স্মরণ সভা হয় জাপানে এবং তাঁর চিতাভস্ম সংরক্ষিত হয় টোকিওর রেনকোজি মন্দিরে। অমৃতা কাউরকে লেখা এক চিঠিতে গান্ধী লেখেন – ‘ সুভাষ বসু ভালোভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বিপথগামী হওয়া সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন।’ সুভাষ তাঁকে প্রথম ‘ জাতির জনক’ বলে সম্মানিত করেছিলেন।

সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক গুরু ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯২৩ সালে তিনি সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি এবং একই সাথে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩০ এর মাঝামাঝি সময়ে সুভাষ ইউরোপ ভ্রমণে যান। বেনিতো মুসোলিনি সহ বিভিন্ন ভারতীয় ছাত্র ও ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের সাথে দেখা করেন। তিনি দলীয় সংগঠন এবং কমিউনিজম ও ফ্যাসিবাদের প্রয়োগ পর্যবেক্ষণ করেন। এই সময়ে তিনি তাঁর ‘ দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ বইয়ের প্রথমাংশ রচনা করেন ১৯২০-৩৪ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিবরণ আছে। এটি ১৯৩৫ এ লন্ডনে প্রকাশিত হলেও ভারতে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন ও কর্মকান্ড আজও দেশবাসীর অনুশীলনের বিষয়। ১৯২৮ ৪ ঠা এপ্রিল কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে তিনি ছাত্র সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেন – ‘…. সাকলাতওয়ালা বলিয়াছেন যে মহাত্মা গান্ধীর তুলনায় লেনিনের অনুগামীদের সংখ্যা ছিলো অল্প। কিন্তু লেনিন তাঁহার লক্ষ্যসাধন করিতে পারিয়াছেন। লেনিনের পক্ষে তাহা সম্ভব হইয়াছে কারণ তাঁহার অনুগামীরা ছিলেন সংগঠিত। যুবকরা তাহাদের নির্মল পর্বে এই মন্ত্র গ্রহন করুক যে এখন হইতে তাহারা সততার সঙ্গে ও যুক্তিযুক্তভাবে দেশের স্বাধীনতার কাজে সাহায্য করিবে।’ তিনি বলেন, ‘… এখানে সেখানে এক আধটু সংস্কার দ্বারা কাজ হইবে না। বাহ্যিক প্রলেপ কার্যকরী হইবে না। সম্পূর্ণ পরিবর্তন, সম্পূর্ণ নতুন পরিগ্রহনই আমাদের বর্তমানে প্রয়োজন। ইহাকে ইচ্ছা করিলে ‘ সম্পূর্ণ বিপ্লব আখ্যা দেওয়া যাইতে পারে।… সমগ্র সমাজের জন্য স্বাধীনতা বলিতে নারী ও পুরুষ এই উভয়েরই স্বাধীনতা বুঝিতে হইবে। শুধু উচ্চ শ্রেণী নয়, অনুন্নত শ্রেণীকেও স্বাধীনতা দিতে হইবে। সকল সম্প্রদায়, সংখ্যা লঘু এবং গুরু সমাজকেই স্বাধীনতা দিতে হইবে। এদিক থেকে বিচার করলে মনে হয়, স্বাধীনতা মানেই সাম্য, আর সাম্য মানেই ভ্রাতৃত্ব।’

১৯২৯ এর ২৯ ডিসেম্বর, মেদিনীপুর যুব সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘ পূর্ণ সাম্যবাদের ওপর নতুন সমাজকে গড়িয়া তুলিতে হইবে। জাতিভেদ, অর্থের অসাম্য, নারী পুরুষের ভেদাভেদ দূর করিতে হইবে। সমাজতন্ত্রমূলক সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র যাহাতে স্থায়ী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় তার জন্য সচেষ্ট হইতে হইবে।’ সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন গান্ধীর অহিংসা ও সত্তাগ্রহ নীতি ভারতেএ স্বাধীনতা লাভের পক্ষে যথেষ্ট নয়। সুভাষ বেছে নিয়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের পথ। তিনি ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রতিষ্ঠাতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরে তিনি ব্রিটিশের দুর্বলতার সুযোগ আদায়ের পথ হিসাবে নেন। গোপনে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মান, জাপান ভ্রমণ করেন। ভারতীয় যুদ্ধবন্দী এবং দক্ষিণ এশিয়ার কর্মরত মজুরদের নিয়ে জাপান সরকার ও রাসবিহারী বসুর সহযোগিতায় গঠন করেন আজাদ হিন্দ ফৌজ ও আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করান। তাঁর ইস্তাহারকে অনেক ভারতীয় মনে করেন রিয়েলপলিটিক। সুভাষচন্দ্র একমাত্র প্রথম প্রবক্তা যিনি ডোমিনিয়িন স্ট্যাটাসের বিরুদ্ধে গিয়ে পূর্ণ স্বরাজের দাবি করেন। ভগৎ সিং এর ফাঁসি এবং তাঁর জীবন রক্ষায় কংগ্রেসের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ সুভাষ গান্ধী – আরউইন চুক্তির বিরোধিতা করেন এবং তাঁর নির্বাসন হয়।

প্রশ্ন জাগে অহিংসা নীতির ওপর। জার্মান সাম্রাজ্যবাদী ছিলো কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের জন্মদাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ছিলো না? সূর্যসেনকে কারাগারে নৃশংসভাবে দাঁত, নখ উপরে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা, রাজগুরু ভগৎ সিং শুকদেবের দেহ ফাঁসির পরে কেঁটে, পুড়িয়ে সরযূর জলে গোপনে ভাসিয়ে দেওয়া, চা বাগানের ঘুমন্ত অবস্থায় শ্রমিকদের ওপরে গুলি চালিয়ে হত্যা করা – অহিংসা?

এসব প্রশ্নের উত্তর সুভাষ পাননি। আমরাও পাইনি। তাই আমাদের আগুন পাখিটা সুভাষের কাছে আগুনের পরশ নেয়। সুভাষ বেঁচে থাকেন শুধু শ্রদ্ধায় নয় ভালোবাসায়। সুভাষচন্দ্রের আদর্শ এক সৈনিকের আদর্শ যা সততা, কর্তব্য, আত্মবলিদানে পূর্ণ। চিন্তনের পক্ষ থেকে জানাই তাঁকে অন্তহীন শ্রদ্ধা, সেলাম।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।