কলমের খোঁচা

ঐতিহাসিক মে দিন প্রসঙ্গে  ———————————সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:০১/০৫/২০২৩:- “আর্থিক সংকট তো রাজনৈতিক সংকট থেকে আলাদা নয়, তারা পরস্পরের প্রতিবিম্ব। এই সোজা* *সত্যটি সম্প্রতি আমরা যে অভিজ্ঞাতর ভিতর দিয়ে গেছি, যাচ্ছি, তা থেকে প্রাঞ্জলতম হয়েছে, হচ্ছে।” এই কথা গুলি বহুবছর আগে তৎকালে আমাদের দেশে  বিরাজমান  অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বোঝাতে (১৯৮১ সালে) তার “ সংকটের স্বরূপ” প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী, সমাজবিজ্ঞানী ডঃ অশোক মিত্র। আজ ২০২৩ সালের মে দিবসে করোনার অভূতপূর্ব সর্বগ্রাসী হামলার অব্যবহিত পরবর্তী পরিমন্ডলে বিশ্ব ব্যাপী শ্রমজীবী মেহনতী মানুষ যখন পালন করতে যাচ্ছেন তাঁদের আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব দিবস “ঐতিহাসিক মে দিবস” তখন, এতটা সময় পার করে এসেও কী এই কথা গুলিকে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে না ? মনে হচ্ছে না কী সমান অর্থবহ ? যদি আমরা একটু প্রসারিত দূষ্টিতে তাকাই তাহলেই কিন্তু ওয়াশিংটন, বার্লিন, প্যারিস, রোম, মাদ্রিদ, টৌকিও বা মস্কো থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতা আমরা খুঁজে পাবো এর সত্যতা। এক মুহূর্ত আমাদের সময় লাগবে না এটা বুঝে নিতে যে,“যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই,
প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই/পৃথিবী অচল আজ তাঁদের সুপরামর্শ ছাড়া। ”আজ যারা বনে বসেছে এই মহাবিশ্বের স্বঘোষিত অধিশ্বর একমাত্র তারাই যেন এই গ্রহটাকে যথেচ্ছ ভাগাভাগির, ভাঙাভাঙির আর লুটের অধিকারী। পৃথীবীর সব প্রাকৃতিক সম্পদ ও শ্রমশক্তিকে বেমালুম আত্মসাৎ করার ‘যাদুকাঠি’ যেন তাদেরই হাতে ! মানবিক মূল্যবোধের সামান্যতম পর্দারও আড়াল ছিন্ন করে হাতে গোনা পঞ্চাশ-একশজন ধান্দার ধনতন্ত্রের গর্ভজাত নির্লজ্জ মুনাফাখোর ধনকুবের এই পৃথিবীর বিপুল সম্পদকে নিজেদের পক্ষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নেওয়ার জন্যে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন, ফন্দি-ফিকির, ছলা-কলার সব কুবিদ্যা করতলগত করে নিয়েছে। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, ১৯৪৪ সাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও বলা চলে সেভাবে থামার লক্ষণ স্পষ্ট করেনি কিন্তু তখই যুদ্ধের গতি প্রকৃতি আঁচ করে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয় নিশ্চিত বুঝে কৌশলী লুটেরা পুঁজিবাদ যুদ্ধোত্তর বিশ্ব পরিস্তিতির “বিপর্যয়কর পরিণতির” গা ছমছমে ব্যাখ্যা সহকারে নতুন সুন্দর পৃথিবীর সাম্য ও সার্বিক স্বাধীনতার সুখস্বপ্নে যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন পৃথিবীকে আলোর পথদীশা (!!!) দেখানোর ধূম্রজ্বাল নির্মাণ করে ধনবাদী দুনিয়ার ইচ্ছানুসারে জন্ম দিয়েছিল আসলে তাদের নিরঙ্কুশ স্বার্থ রক্ষাকারী দুটি মায়াবী মারিচের । প্রথমটি International Monetary Fund বা IMF (আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার), দ্বিতীয়টি International Bank for Reconstruction and Development বা World Bank (বিশ্ব ব্যাঙ্ক)। সাময়িক, অতি সাময়িক সুকৌশলী অভিনয়ের পালা সাঙ্গ করে বিশ্ব পুঁজিবাদের যমজ এই দুই সন্তান কুচক্রী ধনবাদী দুনিয়ার দক্ষ খেলোয়াড়দের ইচ্ছাপুরণে অবশিষ্ট দুনিয়ার তাদের বিচারে বলা চলে বিশেষকরে অবশিষ্ট দুনিয়ার “জঞ্জাল” লক্ষ-কোটি শ্রমজীবি মেহনতী দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের জীবনে কি দুঃসহ দুরবস্থা নামিয়ে এনেছিলো যার ফল অত্যন্ত প্রকটভাবে এখনো ভোগ করছেন বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষ তার সন্ধানে অন্য কোথাও যেতে হবে না আমাদের দেশ ভারতবর্ষের বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রমজীবি গরীব মেহনতী জনগণের জীবনমানের ক্রমান্বয়ে চূড়ান্ত অবনতীর দিকে তাকালেই তা বোধগম্য হবে। ঝড়ের বেগে কমেছে বেতন ও শ্রমের মজুরি। স্থায়ী কাজে স্থায়ী নিয়োগ তো দূরস্থান দেশে নিয়োগই কার্যত বন্ধ। নিয়োগ সামান্য যা আছে তা অত্যন্ত নিম্নহারের মজুরিতে চুক্তি ভিত্তিক। বলা চলে মালিক শ্রেণীর ইচ্ছানুসারে আইনে পর্যবসিত হয়েছে যথেচ্ছ ছাঁটাই। শ্রমজীবীর জীবনে আবছা হতে হতে প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে সভ্যতার সঙ্গে সামান্যতম মানানসই জীবন ধারনের সামান্য সুযোগ- সুবিধা টুকুও। এই সময় আমাদের দেশে মোদী জমানায় নানা ছুতোয় আইনকরে কাড়া হয়েছে শ্রমিক শ্রেণীর, কর্মচারীদের সংগঠিত হওয়ার, প্রতিবাদ নথিভূক্ত করার দীর্ঘদিন সংঘবদ্ধ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আদায় করা স্বীকৃত অধিকার গুলি। নিষিদ্ধ করার সফল ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছে, এখনো হয়ে চলেছে দুনিয়া জোড়া রক্তক্ষয়ী দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের শীর্ষে অর্জিত আট ঘন্টা কাজের ও শ্রমিকদের ন্যায্য ধর্মঘটের সাংবিধানিক অধিকার। সর্বত্র ১২ ঘন্টা, ১৪ ঘন্টা কাজকেই কার্যত মধ্যযুগীয় কায়দায় নিয়মে পরিণত করা হয়েছে। শ্রমজীবীদের সংগঠিত এবং অসংগঠিত উভয়ক্ষেত্রই আজ লুটেরা ধান্দার ধনতন্ত্রের হামলার অবাধ বিচরণ ভূমি। প্রতিটি জিনিসের দাম সাধারণ মানুষে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান তাও অধরা মোট কথা, “যে খাটবে সে খাবেনা, যে সব দেবে সে কিছু পাবেনা” এই হচ্ছে পুঁজির যথেচ্ছাচারের সাদা- সোজা পথ আর মোদ্দা কথা। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঠিক যেমন বলেছেন, “আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে/কারা যেন আজো ভাত রাঁধে / ভাত বাড়ে, ভাত খায়।/ আর আমরা সারারাত জেগে থাকি /আশ্চর্য ভাতের গন্ধে,/প্রার্থনায়।” প্রাপ্য ন্যায্য  অধিকারের ওপর লুটে খাওয়াদের আক্রমণের লক্ষ্য যেহেতু সহায় সম্বলহীন শ্রমশক্তি, আর তার চরিত্র যেহেতু বহুমুখী এবং আন্তর্জাতিক অস্তিত্ব রক্ষায় শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিবাদ প্রতিরোধও অতএব দেশ থেকে দেশান্তরে সংগঠিত, প্রসারিত ও সংহত হয়ে গ্রহণ করেছে আন্তর্জাতিক অবয়ব। ক্রমান্বয়ে চেহারা বদল করে উত্তরসত্য (Post truth) , তথ্য সাম্রাজ্যবাদ বা উগ্র জাতীয়তাবাদের অস্ত্রে সজ্জিত বিশ্ব পুঁজিবাদ বা লগ্নী পুঁজি যখন বিশ্বব্যাপী তার অবাধ,ধ্বংসাত্মক পথ পরিক্রমায় আদতে আক্ষরিক অর্থেই সর্বগ্রাসী ধান্দার ধনতন্ত্রে পর্যবসিত তখন তার সমস্ত শরীর জুড়ে দগদগে ঘায়ের মতো ফুটে বেরোলো সম্মিলিত রক্তে, ঘামে, শ্রমে গড়ে ওঠা  সম্পদের বন্টনে চূড়ান্ত নিষ্ঠুর বৈষম্য, মুষ্টিমেয়র স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদের বিচার বিবেচনাহীন যথেচ্ছ লুঠ, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যবর্তি জীবনরেখার সুস্পষ্ট প্রকট পার্থক্য, লুম্পেন লুঠেরাদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কবচের অন্তর্ভূক্ত করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ছাপান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতিওয়ালা লম্ফঝম্প ইত্যাদি ঘৃণারও অযোগ্য বৈশিষ্ট গুলি। এই বেলেল্লাপনার বিরূদ্ধে এ দেশ, এ পৃথিবী তাই বারবার দেখেছে সর্বহারার সব পাওয়ার স্বপ্ন লালিত হার না মানা জেদি রণহুঙ্কার। সভায়, সমাবেশে, ধর্নায়, একটার পর একটা দেশব্যাপী সফল ধর্মঘটে—অকুতোভয় লক্ষ কোটি শ্রমজীবির ঐক্য ও সংগ্রামের বজ্রনির্ঘোষে এদেশে, এ পৃথিবীতে বারবার স্তব্ধ হয়েছে, বেপথু হয়েছে পুঁজির দাসত্বের প্রতিবাদহীন বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণের ষড়যন্ত্র। আমাদের দেশে জাতের নামে বজ্জাতির রাষ্ট্রীয় বর্বরতার বেআব্রু প্রদর্শন শ্রমিক শ্রেণীর এই লৌহদূঢ় ঐক্যকে সাময়িকভাবে হলেও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়তো করতে পেরেছে সভ্যতার দুশমনরা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী শ্রেষ্ঠ শিক্ষা যখন জীবনলব্ধ তখন জীবনেরই মূখোরিত সখ্যে এই অস্ত্রও লক্ষ্যভ্রষ্ট  করতে সক্ষম হবেন ভারতীয় শ্রমজিবীগণ, বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণী। “মুক্ত করো ভয়, / দুরূহ কাজে নিজেরে দিও/কঠিন পরিচয়।” আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস ঐতিহাসিক মে দিবস উদযাপনের চির অম্লান তাৎপর্য এখানেই। হ্যাঁ, হয়তো একথা আংশিক ঠিক “আপাতত ইতিহাসে অশ্লীলতার প্রলেপ।” কিন্তু তা চিরস্থায়ী হতে পারেনা। পৃথিবীতে তো বটেই আমাদের দেশে এবং রাজ্যেও উভয়বিধ বর্তমান শাসকবর্গের চরমতম ভন্ডামি, দুরাচার, সীমাহীন দূর্নীতি, লুট, নির্ভেজাল মিথ্যাচার, চূড়ান্ত প্রশাসনিক অপদার্থতা, চক্ষু লজ্জার বালাইহীন হাস্যকর দম্ভ, শান্তি ও সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করার ক্লান্তিহীন চক্রান্ত, জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কহীন অমানবিক ঔদ্ধত্যের অসহ্য যন্ত্রণার আবহের মধ্যেও মনকে শক্ত করে তাই ডঃ অশোক মিত্রর বক্তব্যকে উল্লেখ করেই বলতে হয়, “আপাতত চোখের সামনে অভব্য অভিনয় চলছে, আপাতত হয়তো ভয়ঙ্কর সাহসব্যঞ্জক কিছু করার নেই, সেটা হটকারিতা হবে,কিন্তু অন্তত কিছুটা ঘৃণা পুষে রাখুন। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা অর্থহীন অসাধুতা, সমাজে বিপ্লব আনতে হ’লে সর্বাগ্রে দরকার কিছু ঘৃণার মূলধণের,এই ঘৃণা থেকেই একদিন সাহসের অক্ষৌহিণী সূষ্টি হবে”(সূত্রঃ সংকটের স্বরূপ, পৃষ্ঠা ৪৯)। তাই আজ আমরা আরো একবার সোচ্চারে বলবো, মে দিবস তুমি এসো বারবার, আমাদের ধমনীর রক্ত প্রবাহে অহরহ থাকে যেন তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি।
————————
                    


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।