কলমের খোঁচা বিদেশ

শহিদ জননী জাহানারা ইমাম ও মৌলবাদ বিরোধী লড়াই – গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ:৬ই জুন:- শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের সহযোগী ঘাতক দালাল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গত শতাব্দীর নয়ের দশকে বাংলাদেশে উত্তাল গণ সংগ্রাম ,যার ফলশ্রুতিতেই সেই দেশ আজ আবার একটা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ পরিকাঠামোর ভেতরে নিজেকে উপস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছে । জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলনকে বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের’ দ্বিতীয় পর্যায় ‘বলে বর্ণনা করে থাকেন।

মুক্তিযুদ্ধের সেই ‘দ্বিতীয় পর্যায়’ টি নির্যাস আজ কেবলমাত্র বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখার ভিতরে নেই। জাহানারা ইমাম তাঁর ঐতিহাসিক আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেকে গোটা বিশ্বের মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ,যুদ্ধাপরাধ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের এক জীবন্ত প্রতীকে পরিণত করেছেন।

জাহানারা ইমামের জন্ম অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে ১৯২৯ সালের ৩ রা মে। তাঁর পিতা সৈয়দ আবদুল বারী ছিলেন পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট । মা সৈয়দা হামিদা বেগম ছিলেন সে যুগের এক বিশিষ্ট বিদূষী মহিলা ।রাঢ় বাংলার অভিজাত মুসলিম পরিবারের নিজস্ব আয়মাদারির ভেতরেই জাহানারার শৈশব -কৈশোর কাটলেও তাঁর পরিবারে কিন্তু মেয়েদের আধুনিক শিক্ষার ব্যাপারে কোনো রক্ষণশীলতা ছিল না ।তাই কোন রকম পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ১৯৪২ সালে জাহানারা ম্যাট্রিক পাস করেন।

১৯৪৪ সালে তিনি রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে আই এ পাশ করে ‘৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ।সেখান থেকেই ‘৪৭সালে তিনি বিএ পাস করেন ।’৪৮ সালে তিনি ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা পদে যোগদান করেন ।’৪৯ সাল পর্যন্ত সেই স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন ।এরপর চলে আসেন ঢাকায়। যোগ দেন সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে।

১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে পালন করেছিলেন ।এই সময় কালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং শিক্ষা বিজ্ঞানের উচ্চতর গবেষণার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যান। সেখানকার একটি সার্টিফিকেট কোর্স অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকায় ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ উপাধি প্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকাতেই বুলবুল একাডেমী নামে এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তানের শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরনের স্কুলের প্রচলন তখন প্রায় ছিল ই না।পরবর্তীতে তিনি ঢাকা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জাহানারা ইমাম কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক ভাষা বিভাগের খন্ডকালীন অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন ।তাঁর স্বামী শরিফ ইমাম ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। মহান মুক্তিযুদ্ধে জাহানারা ইমামের পুত্র শফি ইমাম রুমী শাহাদাত বরণ করেন ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কালের সেই চোখের জলে ভেজা দিনগুলো র কথা টুকরো টুকরো ছেঁড়া ছেঁড়া কাগজের লিপিবদ্ধ করে রাখতেন জাহানারা ।আস্ত একটা খাতাতে সে দুঃখের কাহিনি লিপিবদ্ধ করার সাহস হতো না ।কারন, পাক হানাদার বাহিনী এসে তাঁর পুত্র ,মুক্তিযোদ্ধা রুমির তল্লাশির নামে সে খাতা খানি কে ও নষ্ট করে দিতে পারে, এই ছিল ভয়।

দেশ স্বাধীন হবার অনেক পরে, বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণের ও পরে যুদ্ধাপরাধী ঘাতক দালালেরা আবার দেশের মাটিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেখে বুকের ভিতর জমিয়ে রাখা কান্না কে ক্রোধে রূপান্তরিত করে, সেই সব হারানো, ছেঁড়া, টুকরো টুকরো কাগজ গুলি কে একত্র করে জাহানারা ইমাম রচনা করেন’ একাত্তরের দিনগুলি ‘।এ বইটি কে শুধু বাংলাদেশের মানুষ নন, গোটা বিশ্বের মানবাধিকারের পক্ষের মানুষ জন বলে থাকেন ;” বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের টেস্টামেন্ট।”

অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে বাংলাদেশে ফিরে আসবার অনুমতি দেওয়ার পরই জাহানারার অন্তরাত্মা থেকে যুদ্ধাপরাধী ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে ক্রোধের এই স্ফুলিঙ্গ উৎসারিত হতে শুরু করেছিল।

খালেদা জিয়া প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পায় এবং একাত্তরের ঘাতক হিসেবে সব থেকে বেশি নিন্দিত জামায়াতে ইসলামী এই গোলাম আযম কে ‘৯১ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর তাদের দলের আমির হিসেবে ঘোষণা করার করে।

গোটা বাংলাদেশের মানুষের এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষোভের ফল্গুধারা কে প্রবাহমান নদীর স্রোতে পরিণত করেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের সমস্ত কুকীর্তির তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ তিনি তৈরি করলেন ‘গণ তদন্ত কমিশন ‘।এই কাজে তাঁর পাশে সব রকমের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন বঙ্গ জননী সুফিয়া কামাল ।

সুফিয়া কামাল নিজে এই গণ তদন্ত কমিশনের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে থেকে শামসুর রাহমান ,কলিম শরাফী, কবীর চৌধুরী ,আহমেদ শরীফ, দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ,অনুপম সেন ,বদরুদ্দীন উমর,শওকত ওসমান প্রমূখ মুক্তবুদ্ধির মানুষদের সঙ্গে নিয়ে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার মানবিক সহযোগিতা কে সম্বল করে তথ্য অনুসন্ধানের কাজটি সমাপ্ত করলেন।

জাহানারা ইমামের ছিল অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা। ব্যক্তিত্বের জেরে তিনি পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর এবং জননেত্রী শেখ হাসিনা কিংবা বিপরীতমুখী ব্যক্তিত্বের কবীর চৌধুরী এবং আহমেদ শরীফ কে ঘাতক দালালদের শাস্তির দাবিতে এক মঞ্চে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

গণ তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ‘৯২ সালের ২৬ শে মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের কুখ্যাত ঘাতক দালাল গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে ন্যুরেনবুর্গের বিচারের অনুসরণে গণ আদালত অনুষ্ঠিত হয়। এই গণ আদালতের সদস্য হিসেবে ছিলেন বঙ্গ জননী সুফিয়া কামাল ,কবি শামসুর রাহমান , শিল্পী কলিম শারাফি, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ,অধ্যাপক আহমদ শরীফ ,এডভোকেট গাজীউল হক,বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, আবু ওসমান চৌধুরী ,বিচারপতি অনুপম সেন প্রমুখ ।

খালেদা জিয়ার সরকার ভয়ঙ্কর রকম ভাবে রুষ্ট হন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সহ গোটা গণআদালত প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা বাংলাদেশের মুক্তবুদ্ধির মানুষজনদের উপরে ।
গণআদালতের সঙ্গে যুক্ত ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অজামিনযোগ্য মামলা দায়ের করে তাঁরা। প্রবল গণরোষের প্রেক্ষিতে কার্যত বাংলাদেশের হাইকোর্ট বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশের বিশিষ্ট এই ২৪ জন নাগরিকের জামিন মঞ্জুর করতে ।

‘৯৩ সালের ২৮ শে মার্চ নির্মূল কমিটির সমাবেশে খালেদা জিয়ার সরকার বর্বরোচিত আক্রমণ চালায়। পুলিশের লাঠিতে গুরুতরভাবে আহত হন ক্যান্সার আক্রান্ত শহিদ জননী জাহানারা ইমাম। তাঁর আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে, তাঁকে পিজি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়েছিল।। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত গোটা বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করে ।

আন্তর্জাতিক স্তরে মানবাধিকার আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তী হিসেবে অভিহিত করা হয় শহীদ জননী কে। জাহানারা ইমামের এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে খুনি মেজর চক্র পাকিস্তান এবং আমেরিকার সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কে সপরিবারে হত্যা করার পর গোটা বাংলাদেশকে যে আবার পাকিস্তানের ছায়া উপনিবেশে পরিণত করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করেছিল ,তা থমকে যায় ।তাঁর এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে দেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ,গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেই সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই গণ আদালতের রায় কে সম্মান জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।

‘৯৪ সালের ২৬ শে জুন শহিদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যু হলেও আজও বাংলাদেশসহ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে মৌলবাদ , সাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম অত্যন্ত জীবন্ত একটি নাম ।একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করার পাশাপাশি জাহানারা ইমামের লেখা অন্য জীবন ,জীবন মৃত্যু ,নিঃসঙ্গ পাইন বু,কের ভিতর আগুন, নাটকের অবসান, দুই মেরু, প্রবাসের দিনলিপি ,ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস ইত্যাদি গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের এক চিরকালীন সম্পদ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।