রঘুনাথ ভট্টাচার্য: চিন্তন নিউজ:৮ই নভেম্বর:–মার্কিনী প্রভাবিত আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার(আই.এম.এফ)কর্তৃপক্ষের
ইন্ধনে ইক্যুয়েডরের মোরেনো সরকার যে ‘ কৃচ্ছ্রতা প্রকল্প ‘
( প্যাকেজ) চালু করেছিল, তার বিরুদ্ধে সেই দেশের জন
সাধারণ প্রবল প্রতিবাদ সংগঠিত করে ২রা অক্টোবর থেকে। সেই প্রতিবাদের আওয়াজ এখন এক অপ্রতিরোধ্য গণবিদ্রোহের রূপ নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (১০/১০) প্রশাসন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।সেই
জন আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ক্রমশঃ। সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনী দিয়েও সে আন্দোলন দমাতে
পারেনি।প্রথম দিনেইএকজন শহিদ হয়েছেন, জনা বারো আহত ও কয়েকশত আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার হন।তা সত্ত্বেও শ্রমিক-কৃষক-যুবদলের এই যৌথ আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে।কয়েকটি অঞ্চলে সরকারী ভবনগুলি আক্রান্ত হয়। শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী গণসঙ্গঠন ‘কোনি'(CONAIE)
নিজেরাই ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে চলেছে। গত ৭ই অক্টোবর ইক্যুয়েডরের এই স্বদেশী(বামপন্থী?) সংগঠন পরিচালিত জনতা দলে দলে রাজধানী শহর ক্যুইটোতে জমায়েৎ হওয়ায়
মোরেনো রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। তাঁর সরকারী দপ্তর গুয়ায়াক্যুইল শহরে সরিয়ে নেয়া হয়। তাঁর
সরকার এখন প্রায় নিস্ক্রিয়।শ্রমিক ও কৃষকের এই মিলিত
আন্দোলনকারী জনতা ৯ই অক্টোবর থেকে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করেন।এইভাবে আই.এম.এফ জনিত ফতোয়ার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল,তাএখন সার্বিক জাতীয় বিদ্রোহে পরিণত। গণপরিবহন কর্মীদের সংগঠনের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে সরকারী ঘোষণা এখন শুধু অতীত পরিহাস। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়িয়েছে বহুগুণে।আন্দোলনের সহকারী সক্রিয় সংগঠন কোনি (CONAIE)সরকারী আক্রমণকে প্রতিরোধ করেছে শুধু তাই নয়, তারা এমনি সংহত যে তারা সরকারী পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে অনেককে গ্রেফতার করতে পেরেছে।
ক্যুইটো শহরের উত্তরে অবস্থিত ওটাভালো ও ইমাবাবুরা প্রদেশে দশজন পুলিশকে গ্রেফতার করে তারা নিজাগ,আলাউসি, ও বর্তমান রাজধানী শহর গুয়ায়াক্যুইল-এর পূর্বের ক্ষেত্রে মোট ৪৭জন সৈন্যকে গ্রেফতার করে ১৩ই অক্টোবর পর্যন্ত, যারা গালাপাগোস আর্মার্ড ক্যাভালরি ব্রিগেডের অধীনে ছিল। একই ক্ষেত্রে ,জনতাকে টিয়ার গ্যাস নিয়ে আক্রমণ করার অপরাধে ১০জন পুলিশ অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়। একই ভাবে, কোটাপাসি প্রদেশে ( ক্যুইটোর দক্ষিণে) জাতীয়তাবাদী শ্রমিক ও কৃষকের যৌথ সংগঠন (ইউনিয়ন অব্ ইন্ডিজেনাস ওয়ার্কার্স এন্ড পীজান্টস কমিউনিটি )একদল পুলিশ ও সৈন্যকে আটক করে কারণ তারা আন্দোলনকারী যুবদলের সদস্যদের আক্রমণ করেছিল।অন্যান্য শহরগুলোতেও সরকারী পুলিশ ও সেনাবাহিনী আন্দোলনকারী জনতাকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয় এবং ফলত নিজেদের গুটিয়ে নেয়। তারা ক্রমশঃ বর্তমান সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততা হারাচ্ছে এবং আন্দোলনকারীদের সমর্থন করতে শুরু করেছে, বিশেষতঃ যখন তারা দেখে যে তাদের নিজেদের মা,বাবা ইত্যাদি আত্মীয়-স্বজন এই আন্দোলনের সামিল।এই পরিস্থিতিতে মোরেনো ‘শুভেচ্ছা সূচক আলোচনা’র ডাক দেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিদ্রোহী জনতা ততক্ষণে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘ হয় প্যাকেজ তোলো, না হয় সরকার গদি ছাড়ো।’
এইভাবে, সোমবার সকাল (১৪/১০) থেকেই প্রশাসন
সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় হয়ে যায়।প্রেসিডেন্ট ভবন ঘিরে সৈন্যরা
সুরক্ষা বলয় তৈরি করে ।কোনি নেতা জেমি ভারগাস আলোচনার প্রস্তাব অস্বীকার করে বলেন যে অত্যাচারী সরকারের সাথে সব সম্পর্কই তারা ছিন্ন করেছে।ইতিমধ্যে জাতীয় যৌথ বাহিনী সবদিক থেকেই রাজধানী ক্যুইটোর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সব সশস্ত্র বাধা পরাস্ত করে তারা এগিয়ে যায়। কোথাও কোথাও তারা সৈন্যদের আর্মার্ড কারও জ্বালিয়ে দেয়। তারা প্রেসিডেন্ট -এর ক্যারোন্ডেলেট প্রাসাদ অবরোধ করে ফেলে। তারা এতই সুসংহত ছিল যে, কিছু সুযোগসন্ধানী দুস্কৃতকারী যারা লুটপাট শুরু করেছিল, জাতীয়বাহিনী তাদের নিরস্ত ও আটক করে।
গুয়ায়াক্যুইলে রাজধানী স্থানান্তরিত করে মোরেনো তার পুরানো কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সমস্ত অপকীর্তির দায়
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো এবং ইক্যুয়েডরের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কোরিয়ার উপর চাপাবার চেস্টা করে মোরেনোর এই বিবৃতি নিতান্তই হাস্যকর বলে গন্য
হয় আন্দোলনকারী তথা তথ্যাভিজ্ঞ মহলে। প্রকৃতপক্ষে গত দু’বছর ধরে যে আন্দোলন ধিকি ধিকি জ্বলছিল, মোরেনোর এই’ কৃচ্ছ্রতা প্যাকেজ ‘ চালু করে জনতাকে সমস্ত সাবসিডি তথা অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার
অপচেষ্টা অগ্নিতে ঘৃতাহুতির কাজ করেছে। যেমন হয়েছিল চিলিতে, ‘ ৩০পেসো ‘ বাসভাড়া বৃদ্ধির ফতোয়ায়।
এই গণজাগরণ এখন ইক্যুয়েডরের কোনায় কোনায়
ছড়িয়ে পড়েছে। ন্যাশনাল এসেম্বলির কাজ স্তব্ধ। যদিও সরকারের এখনও পতন হয়নি, কোনি(CONAIE) ক্যুইটোতে স্বাধীন গণ- পরিষদ গঠন করেছে, যাতে আন্দোলনকারী শ্রমিক-কৃষক- যুবদলের প্রতিনিধিরা সামিল। তারা দেশজুড়ে আহুত সাধারণ ধর্মঘটকে
মান্যতা দিয়েছে।প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিও বসে নেই। তারাও নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্পত্তি রক্ষার তাগিদে ধনীসম্প্রদায় তথা পূজিপতিরা ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল পার্টির ছত্রতলে ভূয়া গণতান্ত্রিকের ছদ্মবেশে আন্দোলনের জনপ্রিয়তা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে সক্রিয় হয়ে উঠছে।কিন্তু আন্দোলন কোনোমতেই পিছিয়ে নেই। সেই কর্মসূচি এখনো সবল। People’s Assembly-র প্রসার ও ব্যাপ্তি অত্যন্ত সুষ্ঠু পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরের সক্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলি ,যেমন কলকারখানা , জনগোষ্ঠী(কমিউনিটি), বিশ্ববিদ্যালয়, মাধ্যমিক স্কুল, ইত্যাদি, সকলকে এই আন্দোলনের সামিল করে নেওয়া হচ্ছে ক্রমে ক্রমে। এইভাবে একটি আত্মনির্ভরশীল সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলাই আন্দোলন-
নেতৃত্বের লক্ষ্য।
ইতিহাস বলছে, ১৯৯৭ ও ২০০০ সালে এই একই ইস্যুতে
যথাক্রমে Bucaram সরকার ও Mahuad সরকারের পতন হয়েছিল। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনতার সংগঠণের হাতে ফিরে আসেনি।যার ফলে , বুর্জোয়া সরকার পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।সেই ভুল সংশোধন করে জনতার সরকার গঠন করাই বর্তমান আন্দোলন কারীদের লক্ষ্য।প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কোরিয়ার
মন্তব্য স্মরণীয় :- ” এই কৃচ্ছ্রতা ভিত্তিক অর্থনীতি লাগু করার প্রচেষ্টা শুধুমাত্র দুর্নীতি ও অপদার্থ তার ফসল নয়,এটা মূলতঃ ইক্যুয়েডরে ধনতন্ত্রের সঙ্কটের
প্রভাব। ইক্যুয়েডরের অর্থনীতি সাম্রাজ্যবাদ ও তন্নিষ্ঠ ব্যবসায়ী মহলের প্রভাবে আচ্ছন্ন, যারা চায় এ দেশের জাতীয় সম্পদ অবাধ রপ্তানীর মাধ্যমে দেশান্তরিত
হবে পুঁজির স্বার্থে। জনসাধারণ যে তিমিরে সেই তিমিরে। এটা চলতে দেয়া যায় না। দেশের রাস্ট্রের পরিচালনার পূর্ণ ক্ষমতা শ্রমিক ও কৃষকের হাতেই আসতে হবে। কাজেই, বর্তমান সরকারের পতন শেষ কথা নয়,সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীর থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনতার হাতে নিয়ে আসতে হবে, যাতে দেশের সম্পদ দেশেরই বৃহত্তর জন
কল্যাণের কাজে নিয়োগ করা যায়।”
মহান নভেম্বর বিপ্লবের ১০৩ তম বার্ষিকী উদযাপনের প্রাক্কালে আজ ইক্যুয়েডর তথা দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের জনগণ যে গণজাগরণের দৃষ্টান্ত রাখছেন,
তারা বিশ্বের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ইতিহাসে উজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।সারা বিশ্বের বিপ্লবাদী মানুষ এর জন্য গর্বিত।