দেবু রায়, চিন্তন নিউজ, ১১ মার্চ: সাম্প্রতিক রবীদ্র ভারতীর ঘটনা বা মালদার চারজন ছাত্রীর গান যে অশালীনতার চরম সীমায় পৌঁছে গেছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অনেকে এর সমালোচনা করছে, অনেকে আবার দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবিও করছে। কিন্তু কতগুলো বিষয় কেউ একটুও তলিয়ে দেখছেন বলে মনে হয় না। তবে যা হয়েছে তা এক কথায় চরম অশালীন, কেউই একে সমর্থন করে না। কিন্তু একটু ভাবলে বোঝা যাবে এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমাদের সংস্কৃতির চূড়ান্ত অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে থেকে। রবীন্দ্রভারটির বা ছাত্রীদের ঘটনা তার চূড়ান্ত রূপ মাত্র।
ইতিহাস আমাদের সব সময়ে একটা শিক্ষা দিয়েছে যে কোনো সংস্কৃতির অবনমনের পিছনে থাকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবনমন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখনই সংস্কৃতির নবজাগরন হয়েছে, সেই সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনৈতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির। তা সেটা যে দেশই হোক না কেন। ইতালির নবজাগরন বা ব্রিটেন বা ঊনবিংশ শতকের শুরুতে রাশিয়া, বা তার পরে চীন।
ঊনবিংশ শতকের শুরুতে বাংলা দেশের নবজাগরন শুরু হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরে। তারপর রবি ঠাকুর, শরৎচন্দ্র। এর পর তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ. অন্নদাশঙ্কর প্রভৃতি। এর সাথে সংস্কৃতির আর একটা অংশ শুরু হয় ৪০ এর দশকে চলচ্চিত্রর মধ্যে দিয়ে, যাকে আধুনিক ভাষায় বলা হয় সিনেমা। অবশ্য নাটক সিনেমার কিছুটা আগে আসে (গিরিশ ঘোষের নটি বিনোদিনী যেটা দেখে শ্রী রামকৃষ্ণ পর্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন)। সংগীত অবশ্য অনেক আগেই ছিলো তবে সেটা সীমাবদ্ধ ছিলো রাজা বা জমিদারদের মধ্যে। যাই হোক এই ইতিহাসকে একটু স্মরন করলে অবমূল্যায়নের কারনটা সহজে বোঝা যাবে।
আজকের ছাত্রছাত্রীদের সাথে দুই-তিন দশক আগের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা তুলনামূলক আলোচনা করলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়। সেই সময় যে শাসন ছিলো, বা যে নিয়মানুবর্তিতা এবং তত্ত্বাবধানে তারা বড়ো হয়েছে এখনকার প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা কি সেটা পায়? না, অবশ্যই না। সেই সময়ের যারা ছাত্র বা ছাত্রী ছিলো, তাঁদের মধ্যে এমন একজনও পাওয়া যাবে না যে নর, নরৌ, নরা মুখস্ত করতে গিয়ে সংস্কৃত পন্ডিত মশায়ের রামগাট্টা খাননি অথবা ক্রিয়ার কাল শিখতে গিয়ে ইংলিশ স্যারের কাছে ডাস্টার পেটা খায়নি বা নল চৌবাচ্চার অঙ্ক শিখতে গিয়ে বেত খায়নি।
কিন্তু তার জন্য অভিভাবকরা কোনো দিন স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের নামে হেড মাস্টারের কাছে নালিশ করেননি। বরং সেই শিক্ষককে কৃতজ্ঞতা জানানোর সাথে এটাও বলতেন যে, “পড়াশুনা না করলে মেরে হাড় গোড় ভেঙ্গে দেবেন। আমি এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।” শুধু স্কুলই নয় পাড়ার বড়োদের কাছেও নির্দেশ থাকতো, “সন্ধ্যা শেষ হলেই ছেলেকে বাড়ি পাঠাবি, না শুনলে মার দিবি। তার জন্য আমি বা তোর বৌদি কখনো তোর কাছে কোনো জবাব চাইবো না।” আর এখন পাড়ার বড় দাদা তো অনেক দূর সামান্য বকুনি দিলেই স্কুলের শিক্ষকদের উল্টে তার শাস্তি, আর এর সাথে জুটেছে মিডিয়া। আর কোনো কাজ নেই, কোনো ঘটনা ঘটলেই শুরু হয়ে যায় ঘটনার পিন্ডি চটকানো। শুরু হয় বিশেষ ভাবে অজ্ঞদের নিয়ে এসে তার পর্যালোচনা, যারা এলেন তাঁদের কেউ বিধান দিলেন পুলিশে নালিশ করতে কেউ বললেন জেল হওয়া উচিত, কেউ বা পারলে ফাঁসির নিদানও দেন। তারপর আসেন মনোস্তত্ত্ববিদরা।
আজকের অভিভাবকরা যখন কড়া শিক্ষকদের নামে নালিশ জানাতে ব্যস্ত, তখন তারাই আবার তাদের ছাত্রজীবনের সময়কে প্রশংসা করেছেন। এরকমই এই অভিভাবক বলেন, “অদ্ভুত লাগে যখন ভাবি যে, আমরা হয়তো জোর বাঁচা বেঁচে গেছি। ভাগ্যিস আমাদের ছাত্র অবস্থায় এই সব মিডিয়া বলুন, বা বিশেষভাবে অজ্ঞরা বলুন বা তথাকথিত মনস্তত্ববিদদের পাল্লায় আমাদের পড়তে হয় নি। তাই একজন সাধারন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হয়ে জন্মানো সত্বেও আজ মাথা উঁচু করে, বিদ্যাকে পুঁজি করে রোজগার করে সংসার প্ৰতিপালন করছি।
( ক্রমশ )