কলমের খোঁচা

সাম্রাজ্যবাদ বনাম সমাজতন্ত্র


গৌতম প্রামাণিক: চিন্তন নিউজ:২৮শে জুলাই:– যেমন গণ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন, তেমনি দেশের সরকারের আন্তর্জাতিক অবস্থান নিয়েও আলোচনার অবশ্যই প্রয়োজন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ১৯৬২ তে চীন নিয়ে সীমান্ত অশান্তি, আর আজকে ২০২০ তে চীন বিতর্ক এক নয়। দেখো সারা বিশ্বে বাজার অর্থনীতির লড়াই নিয়েই সমস্যা শুধুমাত্র এভাবে দেখলে হবে না।

সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর সাম্রাজ্যবাদ তার একছত্র আধিপত্য নিয়ে সমগ্ৰ বিশ্ব জুড়ে মাতব্বরি চালাচ্ছিল, যেমন– হু’, আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, রাষ্ট্রপুঞ্জের মতন জায়গায় অনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলে বিশ্বে অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছিল এতোদিন। আমরা জানি সাম্রাজ্যবাদ কখনোই ঐক্যবদ্ধ নয়, কিন্তু, সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদ ভীষণ ভাবে ঐক্যবদ্ধ। বর্তমানে তার আরও একবার প্রকাশ্যে এলো। এই সাম্রাজ্যবাদ সব সময়েই কিছু আমচা চামচা নিয়ে চলে কারন, তা নাহলে সমর্থনের বিষয় হাত তোলা বা ইয়েসম্যানের সমস্যা হবে, এই মুহূর্তে সবচাইতে বড়ো উদাহরণ আমার দেশের সরকার। ভীষন দোটানায় পড়েছে, মার্কিন হুংকারে প্রকাশ্যে চীনের বিরোধীতা করো!!

বলবেন আপনি ভারতবাসী! দেশের এতো গুলো তরতাজা সৈনিক শহীদ হলেন চীনের দ্বারা, চীন আমার দেশের সীমানা দখল করছে বলছেন মার্কিন হুঁশিয়ারির কথা!!

একটা কথা কয়েকদিন আগে কি কার্গিল যুদ্ধে শহীদ সেনাদের স্মরণের মধ্যে দিয়ে কার্গিল বিজয়োৎসব পালন করলো ভারত সরকার। এ ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন পাকিস্তানের চাইতে সবদিকেই ভারত উন্নত না পাকিস্তান?
যখন মাইনাস ৩০-৩৫ ডিগ্ৰী ঐ অঞ্চলে তখন আমার বিজ্ঞান কি করছিল? স্যাটেলাইট কি করছিল? প্রশ্ন থাকছে পুলুওয়ামায় ৮০-৮২ টা সামরিক বাহিনীর কনভয় যাবে, গোয়েন্দারা ১০ দিন আগে স্বরাষ্ট্র দপ্তরে জানালেও কোনো প্রকার কর্ণপাত করলোনা ভারতীয় সরকার, এতগুলো সৈন্যের মৃত্যু হলো! এসবের কোনো তদন্ত আছে? এতো বড়ো কনভয়, এতো সংখ্যায় সেনাবাহিনী গোয়েন্দা সতর্কতা সত্যেও কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হলোনা!!
কেনো একটা অর্থনৈতিক চরমতম দুর্বল, ধর্মভীরু দেশ, যে নিজের দেশের উগ্ৰপন্থী হামলায় ছাড়খার! যে দেশের সুবিশাল সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ক্রীড়া জগৎ!! যার এতো বিচিত্রময় প্রাকৃতিক সম্পদ, এসব দিয়েই সে স্বনির্ভর হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, সুকৌশলে সে দেশেও ধর্মীয় বিভাজনে সব শেষ, উল্টে মাথার ওপর আস্তানা তৈরি করেছে একদিকে মার্কিন তো আর একদিকে চীন।
মার্কিন কখনোই চায়না আমরা প্রতিবেশী দুই দেশ পারস্পরিক আদান-প্রদান করি। সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র‌ই হলো বিভাজনের মধ্য দিয়ে চলা এখানেও তাই, পাশাপাশি চীনের ভুমিকাও উল্লেখযোগ্য নয়।

আমার দেশ সম্মন্ধে মার্কিন প্রধান ট্রাম্পের ভুমিকা অত্যন্ত জঘন্য, এই অতিমারী পরিস্থিতির আগে থেকেই। যদি দেখতাম যে চিকিৎসা প্রশ্নে, শিক্ষা প্রশ্নে, বানিজ্যিক প্রশ্নে, একটা কিছুতে আমাদের সহযোগিতা করেছে? উল্টে ওদের দেশে আউটসোর্সিং প্রশ্নে ভারতীয়দের প্রতি কি অবর্ণনীয় ব্যবহার করে চলেছে ঐ মানবতার অন্যতম শত্রু মার্কিন প্রসাশন!! দেশের সরকারের কোনো প্রতিবাদ আছে? সেক্ষেত্রে চীনের ভুমিকা অনেকটাই মানবিক, ওষুধ প্রস্তুতের ৭৫ শতাংশ কাঁচা উপকরণ চীন থেকে আসে, বলা হচ্ছে চীন একচেটিয়া বাজার দখলের রাজনীতি করছে!! কিন্তু, সত্যিই কি তাই? এর অন্যতম কারন হলো উদারীকরণ নীতি!! ১৩৫ কোটির জনগণের দেশ এই বাজারের লোভ সকলের, এখানেই প্রতিযোগিতায় সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাবেদার দেশগুলো ভীষন ভাবে পিছিয়ে পড়ছে, ট্রাম্পের রাগ হবে এটাই স্বাভাবিক।

কোভিড পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদ শুধুই ফাঁকা আওয়াজ তা প্রকাশ পেয়ে গেলো সমগ্ৰ বিশ্বে। বিশাল অর্থের চিকিৎসা ছাড়া মহামারী রুখতে বা মোকাবিলায় সাম্রাজ্যবাদ চরমতম ব্যর্থ। বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সমাজতন্ত্র সুশৃঙ্খল, সুচিন্তিত এই মহামারীর মোকাবিলা করা উচিত। দৃষ্টান্তমূলক দেখিয়ে দিয়েছে শত্রু-মিত্রকে দূরে সরিয়ে কিভাবে মানবসভ্যতাকে বাঁচাতে হয়, এই সুযোগে কোনো বদলা নয়, পাশে থাকার বার্তাই হলো একমাত্র স্লোগান। আগে বিশ্ব বাঁচুক! তারপর লড়াই, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি।

এটাই হলো সমাজতন্ত্রের আন্তর্জাতিকতাবাদ!!

আজ যখন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো নিজের দেশবাসী ও দেশ বাঁচাতে ব্যাস্ত, যখন সেই সাম্রাজ্যবাদ-এর পাশে সমাজতন্ত্র হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তখন মার্কিন প্রধান ট্রাম্প মনে করে অশান্তি বাঁধানোর উপযুক্ত সময় এটাই। কারন বিশ্ব বাজারে চীন তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী, এবং বিশ্ব সংস্থাগুলো আজ আমেরিকার খবরদারি মানতে পারছেনা, যেমন হু কে বাধ্য করাতো যে তাদের ভুয়ো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই শ্রেষ্ঠ ব্যাবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করাতে। আজ হু স্বাধীন হলেও সাম্রাজ্যবাদী দালালদের দল ওখানে রয়েই গেছে, অনুরূপ ভাবে বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা, রাষ্ট্রপুঞ্জে।

তাই প্রকৃতপক্ষে ভারতকে চাপ দাও চীন বিরোধীতায়। চীনের দ্রব্য বয়কট করো, ভারত ওষুধ তৈরি করতে না পারলেও কোনো অসুবিধা নেই, আমেরিকা ও তার অন্যান্য সহযোগী দেশগুলো আছে, তারা ওষুধ দেবে চরা দামে, ভারত সরকার নিতে বাধ্য! ঠিক যেমন হাইড্রোক্সাইডক্লোরোকুইন! যে বেঙ্গল কেমিক্যাল লাভজনক সংস্থা, তার এই ওষুধ, ব্লিচিং, ফিনাইল অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের এবং চাহিদা বিশাল, তার বিশাল জমি সম্পত্তি বেচে দেওয়ার জন্য যখন দেশের সরকার উঠে পড়ে লেগেছে, সেই সময়ে আমেরিকার প্রয়োজন হলো ঐ ওষুধের, সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে গেল ওষুধ উৎপাদন আমার দেশবাসী ব্যবহারের আগে আমেরিকার প্রধান পেয়ে গেলো এক হুমকিতে! চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কতকগুলো যুদ্ধ বিমান ইতিমধ্যেই কেনা হয়ে গেলো মানবতার পয়লা নম্বর শত্রু মার্কিনদের থেকে। ইতিমধ্যেই ভারত মহাসাগরে দক্ষিণ চীন সাগরের সীমান্তে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও তার অন্যতম বন্ধু সমগ্ৰ ভারতবাসী নয়, ভারত সরকার সমুদ্রের সামরিক মহড়া জোর কদমে শুরু করে দিয়েছে।

ভারত সরকার বিশ্বে আমেরিকার সবচাইতে বিশ্বস্ত বন্ধু,যে নিজের দেশের মানুষ অর্থের অভাবে মারা যাক, কিন্তু, আমেরিকার সেবা করতে হবে, উদাহরণ স্বরূপ——আমাদের এই বিশাল দেশ, এখানে জ্বালানি তেলে কিনে মজুত করার জায়গা খুঁজে পায়না! জ্বালানি তেল মজুত রাখার জন্য আমেরিকার তেল মজুত কারী বেসরকারি সংস্থা ভাড়া নিয়েছে আমেরিকায়। বিশাল চড়া ভাড়া, শুধু সেখানে তেল রাখাই নয়, সেখান থেকে বিশাল অংকের জাহাজ ভাড়ায় আবার নিয়ে আসতে হবে, আবার যেখান থেকে তেল কিনবে সেখান থেকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে হবে। এ এক বিশাল সময়ের ব্যাপার ও বিশাল অংকের খরচ, এর সবটাই চাপবে দেশবাসীর কাঁধে! ভাবুন, মূল্যবৃদ্ধি আগামী দিনে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!!

আমেরিকান আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পের পুনরায় প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রশ্নে যথেষ্ট সংশয়ের। ফলে ভারত সরকার ট্রাম্পের অন্যতম বন্ধু, ওক সঙ্গে রাখতেই হবে, ভারত সরকারের মধ্যে ফ্যাসিস্ট চরিত্র ১০০ শতাংশ বিরাজমান। যেভাবে বিভাজন হওয়া উচিত তাই চরিত্রের, ইরানকে মারবার জন্য বিরাট সাহায্য করছে, বাধা একমাত্র চীন, সুতরাং তাকে চাই।

শিক্ষাঙ্গনেও মেরুকরণ, স্বাস্থ্যেও মেরুকরণ (যেমন গুজরাটে কোভিড রোগিদের একদিকে হিন্দু আর একদিকে মুসলিম রাখা হয়েছে), যে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দেশের মেরুদন্ড (রেল, ব্যাংক, বীমা, খনি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, আকাশ পথ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য) সব বেসরকারিকরণ এ এক ভয়নোক সর্বনাশা পদক্ষেপ।

খুব স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদ তার লক্ষ‍্য সমাজতন্ত্রের বিরোধীতা নয় তাকে ধ্বংস করা। তাই এদেশের কোথায় কোথায় কমিউনিস্ট পার্টি বা বামপন্থী দলগুলো আছে সেখানে যেকোনো কৌশলে তাদের আটকাও ও ধ্বংস করো।

তারজন্য প্রথমেই লক্ষ করো আদালত বা বিচার ব্যাবস্থাকে, তদন্তকারী সংস্থা, শিক্ষা ব্যাবস্থাকে একবগ্গা মেরুকরণ, স্বাস্থ্যকে সম্পূর্ন বেসরকারিকরণ, নিজের কব্জায় নিয়ে বামপন্থাকে আক্রমণ। দেখুন দেশের ও রাজ্যের সরকারের ভূমিকা।

কাউকে পরিকল্পনা মাফিক খুন করতে গেলে তার প্রতি সামাজিক ঘৃণা তৈরি করতে পারলে, তাকে খুনের পরে সবাই বলবে জঘন্য ছিল, মেরেছে ঠিক করেছে!!

ঠিক তেমনি—
রাজ্যের সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা করা হচ্ছে!! ভাবুন যে স্কুলে পড়ে আপনি উচ্চশিক্ষা লাভ করলেন, প্রতিষ্ঠিত হলেন, সেই ব্যবস্থায় আপনার সন্তানকে ভর্তি করতে ভয় পাচ্ছেন। পিএসসি,এসএসসির কোনো শিক্ষক নিয়োগ নেই, কলেজ সার্ভিস কমিশন বন্ধ, ফলে সাধারণ মানুষ বেসরকারি ব্যাবস্থায় যেতে বাধ্য! স্বাস্থ্য তেও তাই, সরকারি ব্যবস্থাপনায় চূড়ান্ত ব্যর্থতা, চুরমার হয়ে গেছে, সাধারণ মানুষের ন্যুনতম আস্থা নেই, স্বাভাবিক ভাবেই বেসরকারি ব্যবস্থায় লাগামহীন খরচ সরকার চুপচাপ।
পাশাপাশি কেরলে বামপন্থী সরকার!! কিভাবে বেসরকারি স্বাস্থ্যের ওপরে লাগাম। সরকারি নির্দেশের বাইরে এক পাও চলার উপায় নেই।
দেখুন কেরলের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে কোনো আলোচনা নেই প্রধানমন্ত্রীর, অথচ সমস্ত ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থ ও চুরি কেলেঙ্কারিতে ভরা আমার রাজ্যের সরকার ও তার দল, প্রধানমন্ত্রী তার সাথেই আলোচনা করেন গুরুত্ব সহকারে।

কারণ কি—-
সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা, ভারত সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ জোটের অন্যতম শরিক, বকলমে এখানে তৃণমূল কংগ্রেস। যতো বড়ই বামপন্থী পক্ষে মানুষের ঝড় উঠুক, সাম্রাজ্যবাদ সহযোগী ফ্যাসিস্ট সব নজরে রাখছে, প্রবল জনমত প্রতিরোধ ছাড়া সম্ভব নয়। যারা ভাবছেন তৃণমূল হঠাতে বিজেপি দরকার তাদের যত শীঘ্র চিহ্নিত করে তাদের কাছে পৌঁছে গিয়ে বলতে হবে এই বিপদজ্জনক সমাজ ও দেশের শত্রু কতো ভয়ংকর এবং তার কি কুৎসিত রূপ!! মানুষের ফ্যাসিস্ট সম্মন্ধে ধারণা নেই।

(সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত)


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।