কলমের খোঁচা

ইতিহাস মনে করতে হবে,


নিজস্ব প্র্তিবেদন, অর্পণ গাঙ্গুলী:- চিন্তন নিউজ:১৬ই আগস্ট:– স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা। সেটা প্রচার করে সরকারী ও বেসরকারী গণমাধ্যম। এটা একটা রেওয়াজ। প্রকৃত সত‍্যকে আড়াল করার পরম্পরাও পুরোনোই। ফলে অনেক কিছুই অজানা ও বিকৃত হয়ে চলেছে। তাই আজ কিছু ঐতিহাসিক সত্যকাহিনী তুলে ধরলাম এই স‍োস‍্যাল মিডিয়ায়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় না থাকা দলের মানুষজনের যে ক্ষমতা আগে সে অর্থে ছিল না।

প্রথম ঘটনা:– ১৯২১ সাল, জাতীয় কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশন। এই অধিবেশনেই প্রথমবারের মতো ব্রিটিশের হাত থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলা হয়। দাবি তুলেছিলেন দু’জন, স্বামী কুমারানন্দ ও মৌলানা হসরত মোহানি। দুজনেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।

দ্বিতীয় ঘটনা :— ১৯৩২ সাল। সবে পরীক্ষা দিয়ে উঠেছে ওই কিশোর, সায়েন্স প্র্যাকটিক্যাল তখনো বাকি। ভগত সিং এর প্রথম শহিদ বার্ষিকী পালনের কথা হচ্ছে। গর্ভনর এর সেদিন জলন্ধর থেকে ৪০ কিমি দূরে হোসিয়ারপুর দেখতে আসার কথা। জেলা কংগ্রেস কমিটি ঘোষণা করলো যে সেদিন জেলা আদালত প্রাঙ্গনে ইউনিয়ান জ্যাক এর বদলে ত্রিবর্ন পতাকা ওড়ানো হবে। এই কর্মসূচি বানচাল করার জন্য জেলা শাসক আর্মি মোতায়েন করেন আর কেউ পতাকা তোলার চেষ্টা করলে তাকে গুলি করার আদেশ জারি করেন। সেদিন হোসিয়ারপুর পোঁছে মন খারাপ কিশোরের। শুনলো পতাকা তোলার কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। কংগ্রেস অফিস সম্পাদক হনুমানজির কাছে কিশোর দাবি করলো, কেন বাতিল হল। উনি প্রশ্ন করলেন, গুলি চালানোর আদেশ এর কথা ঐ কিশোর জানে কি না। তাই শুনে খেপে গিয়ে কিশোর পাল্টা বললো, “গুলি খাওয়ার ভয়ে আপনারা হাল ছেড়ে দিলেন ? এত জাতির প্রতি অপমান!” উনি পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে বসেন,” এতই যদি তোমার সাহস, তাহলে তুমিই পতাকা তুলে দেখাও।”
কিশোরটি অফিসের একটি ডান্ডায় লাগানো পতাকা খুলে নিয়ে কোর্টের দিকে দৌড় দিল, সেই আদালত যাকে সেই সময়ে ব্রিটিশ শক্তির একটা নিদর্শন হিসেবে ধরা হতো। কর্মসূচির নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়াতে তখন পুলিশ আর সেনাবাহিনীর মধ্যে একটু ঢিলেঢালা ভাব। তার সুযোগ নিয়ে সিঁড়ি টপকে ছাদে উঠলো কিশোর, ইউনিয়ন জ্যাক খুলে নামিয়ে দিল, লাগিয়ে দিল ত্রিবর্ন পতাকা। তাই দেখার পরে গুলি চালানো শুরু হয়। দুটো গুলি কিশোরের কাছ দিয়ে বেরিয়ে যায়, গায়ে লাগেনি। ডেপুটি কমিশনার বাখলে বেরিয়ে আসেন। কিশোরটিকে বাচ্চা ছেলে দেখে তিনি গুলি চালানো বন্ধ করার আদেশ দেন। কিশোর স্লোগান দিতে শুরু করে। তার কাছে কোনো অস্ত্র নেই,সে নিরস্ত্র এটা নিশ্চিত হওয়ার পরে সেনারা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে যায়।
পরের দিন বিচার শুরু হয়। ম্যাজিস্ট্রেট নাম জিজ্ঞেস করলে কিশোর বলে, “আমার নাম লন্ডন তোড় সিং।” আসল নাম কিছুতেই বের করতে পারেনি। যা করেছে তার দায় স্বীকার করে কিশোর, ভগত সিং এর অনুপ্রেরণার কথা বলে। ওর এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। “মাত্র এক বছর ?” ম্যাজিস্ট্রেটকে জিজ্ঞেস করাতে উনি বাড়িয়ে চার বছর কারাবাস এর আদেশ দেন।” সেদিন জাতীয় পতাকা তোলার জন্য প্রাণ তুচ্ছ করে এগিয়ে আসা কিশোরের আসল নাম হরকিসেন সিংহ সুরজিৎ। ডান্ডা বেড়ি পরে অকথ্য পরিবেশে হাজতবাস করা সেদিনের সেই কিশোর পরবর্তীকালে ভারতের মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির প্রথম পলিটব্যুরোর নবরত্ন এর একজন এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন।

তৃতীয় ঘটনা:- ১৯৪২ সাল। “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনে যোগ দিয়েছে এক ছাত্রী। ১৫ আগস্ট জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেলেন গান্ধীজির সচিব মহাদেব দেশাই। অহল্যার নেতৃত্বে ছাত্রীরা পথে নামলো প্রতিবাদে। মিছিল। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হল ছাত্রীটি, হল তিনমাসের জেল, পুণের ইয়েরওয়াড়ায়। জেলের মধ্যে থাকাকালীন আবার অবাধ্যতার জন্য শাস্তি হয় ছাত্রীটির, বন্ধু ইন্দুতাই কেরকারের সাথে সাত দিনের সলিটারী।
সেই ছাত্রীটির নেতৃত্বে ঠিক হয় ইয়েরওয়াড়া জেলের উঁচু পাঁচিল সাজানো হবে জাতীয় পতাকায় যাতে দূর দূর থেকে লোক দেখতে পারে। প্রথমে মহিলা বন্দীদের কাছ থেকে শাড়ি সংগ্রহ করা হয়। তার পরে সেগুলির কাপড় থেকে সেলাই করে তৈরি হয় জাতীয় পতাকা। এবার ওড়ানো হবে সেই পতাকা। কিন্তু কি ভাবে ? মহারাষ্ট্রে ছেলেরা একজন আরেকজনের পিঠে কাঁধে চড়ে হিউম্যান পিরামিড তৈরিতে ওস্তাদ। সেই আইডিয়া ধার করে মেয়েদের দিয়ে তৈরি হয় হিউম্যান পিরামিড। জেলের প্রাচীরের ওপরে পৌঁছে গিয়ে তোলা হয় জাতীয় পতাকা। ছাত্রীটির মুঠি বাঁধা হাত তখন আকাশের দিকে। ছাত্রীটির নাম অহল্যা রঙ্গনেকর যার জঙ্গী মনোভাব দেখে পদবি পাল্টে ডাকা হত অহল্যা “রণরঙ্গিনী” বলে। ছাড়া পাওয়ার পরে মহিলা সংগঠনের নেত্রী, মুম্বাই এর কর্পোরেটর, সাংসদ, সিআইটিইউ এই ভাইস প্রেসিডেন্ট, মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভ্য।

শেষ ঘটনা:— ১৯৪৭ সাল। শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে এই কমরেড প্রথমে কংগ্রেসে তার পরে কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টিতে। তার পরে মোহ ভঙ্গ হয়ে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। স্বাধীনতার আগেই অসংখ্যবার কারাবরণ, অত্যাচার সহ্য করা আবার আরেকদিকে প্রথম শ্রেণীর বন্দীর আরাম আয়েশ অগ্রাহ্য করে জেল ভেঙে বেরিয়ে আসা। কালিকট এ ১৯৪৬ সালে পার্টির প্রার্থী। কংগ্রেস এর হাতে হেরে যাওয়া। গণ আন্দোলনে আবার ঝাঁপ পুনাপ্রা ভায়ালার, বিড়ি শ্রমিক ধর্মঘট, চিড়াক্কল কৃষক বিদ্রোহ।
মাদ্রাজে তখন প্রকাশম মন্ত্রিসভা। কমরেডকে আবার জেলে ভরা হল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের সেই রাতে কুন্নুর জেলের সলিটারী সেলের গারদ ভেদ করে ভেসে আসছে আওয়াজ, “মহাত্মা গাঁধীজি কি জয়, ভারতমাতা কি জয়।”। কমরেড এর নিজের জবানিতে, “গোটা দেশ অপেক্ষায় আছে কাল সকালের সূর্যোদয়ের, তার পরেই শুরু হবে উৎসব। কতজন কত বছর ধরে অপেক্ষা করছে, সংগ্রামে আত্মত্যাগ করেছে। আমিও ওই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আনন্দিত যার জন্য আমি জীবন-যৌবনকে উৎসর্গ করেছিলাম।” কমরেড বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন কংগ্রেস এর হাতে বন্দী হয়ে, আর তারই এককালের সহকর্মী তখন বিশ্বের সামনে ভাষণ দিচ্ছেন “নিয়তির সাথে অভিসার”।
পরের দিন সকাল। একটা তেরঙা পতাকা জোগাড় করে সেটা তুলে জেল চৌহদ্দির পরিধি বরাবর হাঁটলেন কমরেড। তারপর জেলের ছাদে তোলা হল সেই পতাকা। সব বন্দীরা তার সামনে জড়ো। কমরেড তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তাদের বুঝিয়ে বললেন দিনটির তাৎপর্য। নেমে এসে আবার সলিটারী সেল। জেলার এর বদান্যতার কয়েক ঘন্টার মেয়াদ শেষ।
কমরেড এর নাম এ কে গোপালন। ছাড়া পাওয়ার পরে পাঁচ বার সাংসদ। ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির এর প্রথম পলিটব্যুরোর নবরত্ন এর একজন।

স্বাধীনতার ৭৫ বছরের বুড়িয়ে যাওয়া অগ্রাহ্য করে সেই জাতীয় পতাকা উঠল দেশের কোনায় কোনায়। আসুন, একবার, সেই পুরোনো রংচটা তিনটে পতাকার কথা মনে করি। হোসিয়ারপুর আদালতের মাথায়, ইয়েরওয়াড়া জেলের প্রাঙ্গনে, কুন্নুর জেলের পাঁচিলের ওপর পতপত করে উড়তে থাকা সেই পতাকা, আমার আপনার প্রিয় তেরঙ্গা। কিন্তু এই আবেগটা ধরে রাখতে হবে সারা বছরভর, গতকাল যে আদরে এঁকে ভরিয়ে দিলাম আজ তাঁর জায়গা যেন রাস্তার ধারে, আবর্জনার স্তুপে না হয়।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।