বিদেশ

ইথিওপিয়ার গ্র‍্যান্ড রেনেসাঁ ড‍্যাম ইস্যুতে মিশর, সুদান ও ইথিওপিয়া বোঝাপড়ায় আসতে সমর্থ ।


কিংশুক ভট্টাচার্য:চিন্তন নিউজ: ২৩ জুলাই:– ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যাব‍্যে আহমেদা গত মঙ্গলবার বলেছেন “নীলনদ উপত‍্যকার তিনটি দেশ মিশর, সুদান ও ইথিওপিয়া একটি সাধারন বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পেরেছে। যাকে খুব দ্রুত এক ঐতিহাসিক চূক্তি স্বাক্ষরের পথে উল্লেখযোগ‍্য পদক্ষেপ”। এই নদীবাঁধকে কেন্দ্র করে নীলনদ উপত‍্যকায় গভীর উত্তেজনার ঘণীভূত হয়ে চলেছিল যা ক্রমশ সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।

ইথিওপিয়া প্রায় চার দশমিক ছয় বিলিয়ন ডলার ব‍্যয় করে নীলনদের উপর অববাহিকায় গ্র‍্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড‍্যাম প্রোজেক্ট রূপায়ন শুরু করেছে গত দুইহাজার এগারো সালে। ইথিওপিয়ার বক্তব‍্য অনুযায়ী এই প্রকল্পের ফলে অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারি কয়েক কোটি মানুষ এর ফলে উপকৃত হবে। প্রায় এগারো কোটি মানুষের দারিদ্র্য মুক্তি হবে একই সাথে ইথিওপিয়া এই অঞ্চলের অন‍্যতম প্রধান বিদ‍্যুৎ সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠতে সমর্থ হবে।

অপরদিকে নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত মিশর এবং সুদান তাদের দেশের জল সরবরাহের ক্ষেত্রে এই নদীবাঁধকে এক গভীর হুমকির চোখে দেখছে। বিশেষত মিশরের স্বাদু জলের অন‍্যতম মাধ‍্যম এই নীলনদ। এর ফলে তাদের পাণীয় জল সরবরাহ সহ সেচের জন‍্য নীল নদের উপর সম্পূর্ন নির্ভরশীল।মিশরের মতে এই বাঁধের ফলে নিম্ন অববাহিকায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাবের সম্ভাবনা জন্ম নিচ্ছে। এর ফলে নিম্ন অববাহিকার দশকোটি মানুষ প্রভাবিত হবে এবং চাষের কাজের প্রভূত ক্ষতি হবে। সুদান ও অনেকাংশে এর উপর নির্ভরশীল। উভয় দেশের স্বার্থের সংঘাতে সুদান বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে চলেছে।

গত সপ্তাহে ইথিওপিয়া প্রধানমন্ত্রী অ্যাবে আহমেদার দপ্তর থেকে প্রকাশিত বিবৃতির সাথে যে উপগ্রহ চিত্র প্রচার করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ঐ নদীবাঁধ প্রকল্পের জলাধারের জলস্তর বিগত চার বছরের মধ‍্যে সর্বচ্চো বৃদ্ধি পেয়েছে। জলজমার কথা স্বীকার করলেও আধিকারিকদের কথানুসারে নির্মাণের সাধারণ নিয়মেই এই জল জমা হচ্ছে। অপরদিকে সরকারিভাবে ইথিওপিয়া দাবী করেছে বর্ষাকালের গত দুই সপ্তাহের ভারী বৃষ্টিপাত এই জলজমার অন‍্যতম কারন। এরফলে নীলনদের উপত‍্যকার বর্ষাকালের বন‍্যার প্রভাব কম দেখা গিয়েছে। প্রথম বছরের জলধারনের লক্ষমাত্রা পূরন করা সহজ হয়েছে এবং নির্মিয়মান জলাধার ইতিমধ‍্যেই ভর্তি হয়ে গিয়েছে। আফ্রিকার বৃহত্তম নদীবাঁধ ও জলাধার তার কাজ শুরু করে দিয়েছে।

কিন্তু আবার একটা নতুন বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে তিনটি দেশের প্রধান পরবর্তীতে প্রযুক্তিগত বিষয়ে বিশদে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহন করবে এবং একটা যুক্তিগ্রাহ‍্য সর্বঙ্গীন চূক্তিতে উপনীত হবার উদ‍্যোগ গ্রহন করবে। এই আলোচনা বর্তমানে আফ্রিকান ইউনিয়ন এর প্রধান ও দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি সিরিল রামফোসের মধ‍্যস্থতায় সম্পন্ন হয়েছে। যদিও বিবৃতিতে বিস্তারিত ভাবে কিছু উল্লেখ করা হয়নি বলেই এএফপিকে উদ্ধৃত করে আলজাজিরা সংবাদ মাধ‍্যম জানিয়েছে।

খবরে প্রকাশ তিন প্রধানের মধ‍্যে সঙ্কটের মুল সম্পর্কে গুরুত্বের সাথে আলোচনা হয়েছে এবং নীল উপত‍্যকায় উত্তেজনা প্রশমনের যুক্তিগ্রাহ‍্য সর্বজনগ্রাহ্য শর্তে চুক্তি রূপায়নের রাস্তা খুঁজে বার করতে সচেষ্ট হতে একমত হয়েছেন।

মিশরের রাষ্ট্রপতি আবদেল ফতাহ্ এল সিসি জানিয়েছেন মিশর এই বিতর্কিত সমস‍্যার সমাধনে যথেষ্ট আন্তরিক। এক মুখপাত্র বলেছেন “তিন প্রধান জলাধারে জলভর্তি ও নিয়ন্ত্রনের ভিত্তি হিসেবেএকটি সাধারন যুক্তিগ্রাহ‍্য আইনসিদ্ধ সিদ্ধান্তে আবদ্ধ হবার পথ খুঁজে বার করাতেই প্রাধান্য দিয়েছেন”। সুদানের সেচমন্ত্রী ঈয়াসের আব্বাস রাজধানী খাতুমে বলেছেন তিন প্রধান এই নির্দিষ্ট বিষয়ের সমাধানের স্বার্থে আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যেতে সহমত পোষণ করেছেন।

মিশর ইতিমধ্যে ই রাষ্ট্রসংঘের দরজায় কড়া নেড়েছে। যদিও ইথিওপিয়া মনে করে নদীবাঁধ এর “পরিস্কার ও যুক্তিগ্রাহ‍্য ব‍্যাবহার” নীতির ভিত্তিতে ই আলোচনায় এগোতে হবে। ইথিওপিয়া র অধিকার থাকবে ক্ষরা মরসুমে জল ছাড়ার মাত্রা নিয়ন্ত্রনের এবং এই চুক্তি হবে যথেষ্ট দৃঢ়হতে হবে। উত্তেজনার প্রশমণে আরও কিছু নির্দিষ্ট বিষয় থাকলেও ইথিওপিয়া র জল ছাড়া ইত‍্যাদির মাত্রা সঠিকভাবে নির্ধারণ সমস‍্যা সমাধান হলেই অন‍্যন‍্য বিষয়গুলি সহজে নিস্পত্তি হয়ে যাবে। সুদানের প্রধানমন্ত্রী আবদেল্লা হামদোক ও ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতিতে মঙ্গবারের আলোচনাকে ফলপ্রসু বলে অভিহিত করেছেন।

মধ‍্যস্থতাকারিরা প্রায় সবাই মনে করছেন ইথিওপিয়া যেহেতু কোনও স্থায়ী সালিসি নির্ধারণ শর্তে রাজি নয় সেই হেতু প্রধান প্রশ্ন এটাই যে যদি পর্যায়ক্রমিকভাবে ক্ষরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তখন ইথিওপিয়া কত পরিমাণ জল নিম্নঅববাহিকার জন‍্য ছাড়বে এবং ভবিষ্যতে বিরোধের মিমাংসার সূত্র কি হবে ?

আফ্রিকান ইউনিয়নের কমিশনের চেয়ারম্যান মোসা ফাকি মহমাত তাঁর ট‍্যুইটার হান্ডেলে মন্তব‍্য করেছেন, “মিশর, সুদান ও ইথিওপিয়াকে আফ্রিকান ইউনিয়নের মধ‍্যস্থতায় সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষাকারী একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া এই মুহুর্তে খুবই জরুরি, একমাত্র এই পথেই নীলনদ উপত‍্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার রাস্তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে”। মনে রাখতে হবে বেশ কিছু বছরের এই বিরোধে বেশ কয়েকজন মধ‍্যস্থতাকারি সমাধানের চেষ্টা করে ব‍্যার্থ হয়েছেন।

এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশগত পরিবর্তনের উপর কর্মরত প্রতিষ্ঠানের এক গবেষক কেভিন হুইলার বলেছেন এই মুহুর্তে হঠাৎ করে জল সঞ্চয়ের ফলে কোন জটিল সমস‍্যার জন্ম হবার কোন সম্ভাবনা নেই। এসম্পর্কে তিলকে তালকরে দেখানর একটা প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। এটা ঐ অববাহিকা অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তনের প্রচেষ্টার কারনেই হচ্ছে বলে মনে হয়। যদিও উপূর্যপুরি কয়েকবছর যাবৎ ক্ষরা চলে তাহলে অবশ‍্য এটা একটা ঝুঁকির কারন হয়ে দেখা দেবে।

এই দীর্ঘ কয়েকবছর
যাবৎ বিতর্কের মুল হচ্ছে এই অঞ্চলের বিদ‍্যুতের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও নিজের ঊন্নয়নে গতি আনার ইথিওপিয়া র প্রচেষ্টা আর নিম্নঅববাহিকায় অবস্থিত নীল নদের উপর অতি নির্ভরশীল অর্থনৈতিক শক্তি ধরে রাখতে না পারার মিশরের আশঙ্কা। বিশেষত এতো দ্রুত জলাধারে জলধার ভর্তি হওয়া শুরু হয় তাহলে তাদের জলের ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর এই দুই শক্তির প্রতিযোগীতার বলি হচ্ছে সুদান।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।