দেশ বিদেশ

রিক্ততার বক্ষ মাঝে পরের তরে নিজের উদঘাটন – গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ:২০শে জুন:- একজন আপাদমস্তক বামপন্থীর কাছে নিজের সত্ত্বা আর তাঁর আদর্শের সত্ত্বাকে সন্মিলিত করে, সেই মিলিতস্রোত মানুষের স্বার্থে প্রবাহিত করাই হল জীবনের একমাত্র ধর্ম। নাস্তিক কামাল লোহানী, শঙ্খ ঘোষের ভাষায় এভাবেই শূন্যতাকে ভরিয়ে দিয়ে জীবনের ধর্ম পালন করতে করতেই আজ নশ্বর শরীর ত্যাগ করলেন। শরীরে হারিয়ে গেলেও রেখে গেলেন এক উজ্জ্বল দীপশিখা।সেই দীপশিখা , যাকে বহু ঝড় বাদলেও তিনি কখনো নিভতে দেন নি।প্রদীপের জ্বালানি শেষ হওয়ার আশঙ্কা হলেই যেন নিজের মনে গেয়ে উঠতেন; ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে।’ তাই আজ কামাল লোহানির নশ্বর শরীরে চিরবিদায়ের পর আমাদের শপথ; আঘাত হয়ে দেখা দিল, আঘাত হয়ে জ্বলবে।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সিরাজগঞ্জ , হিন্দু- মুসলমানের কেবল তত্ত্বের নয়, স্বত্ত্বের বিরোধের শেষ মীমাংসা প্রচেষ্টার উপবনে ‘৩৪ সালের ছাব্বিশে জুন তাঁর জন্ম। জন্মদিনের ঠিক ছটি প্রভাত আগে শেষ সূর্যের আলোতে স্নাত হয়ে মুক্তচিন্তার ধারাবাহিকতার চিরসংগ্রামী মানুষটি বিদায় নিলেন। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সনতলাতে যে লড়াই একদিন শুরু করেছিলেন, সেই লড়াইয়ের বাহ্যিক সমাপ্তি টানলেন তিনি ঢাকার মহাখালিতে। অবিভক্ত পাবনার সিরাজগঞ্জ সম্মিলনের ‘ বেঙ্গল প্যাক্ট’ থেকে , আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বাধীন বাংলার জালিওয়ানালাবাগ,’ সালেঙ্গা’ হয়ে প্রমথ চৌধুরীর ‘ চাটমোহর ‘ ছুঁয়ে , কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের কালে পার্ক সার্কাসে জহির রায়হান, সৈয়দ হাসান ইমামদের সঙ্গে তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তী সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহের বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার পরিচালনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘৯২ এর ২৬ শে মার্চ শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন ঐতিহাসিক গণ আদালতের প্রেক্ষিত রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন– এই সবের মাঝেই কাঁটাতারের বাঁধা অতিক্রম করে মানুষের জন্যে একটা লাল টুকটুকে ভোর আনার স্বপ্নের কারিগর হিশেবে কামাল লোহানি চিরদিন বেঁচে থাকবেন মানুষেরই হৃদয়ে।

বিভাগোত্তর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে বামপন্থার বিকাশে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ। তাঁর নেতৃত্বাধীন তেভাগা বিভাগ পূর্ব এবং বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিষ প্রতিরোধে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। সেই ইতিহাসের প্রভাব নিঃসন্দেহে পড়েছিল ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে। মুসলিম জাতীয়তার বিষকে সমূলে উৎপাটন করে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে জীবনপণ সংগ্রাম , সেই সংগ্রামের ভিত্তি ভূমি তৈরিতে মনসুর হাবিবুল্লাহ, সত্যেন সেন প্রমুখের যে অবদান, সেই অবদানের ধারাবাহিকতা বয়ে চলার ক্ষেত্রে শহিদুল্লাহ কায়সার, কলিম শরাফি, সৈয়দ হাসান ইমামদের মতো প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে একবন্ধনীতে উচ্চারিত হয় কামাল লোহানির নাম।

ভারতীয় উপমহাদেশে সাংবাদিকতার সুউচ্চ মর্যাদা স্থাপনে কুমারখালির কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ‘ গ্রামবার্তা প্রবেশিকা’ র ভিতর দিয়ে ইতিহাসের ভিত স্থাপন করেছিলেন।সেই ভিতের উপর ইমারত নির্মাণে মুজিবর রহমান ( দি মুসলমানের সম্পাদক) , প্রফুল্ল সরকার, মওলানা আকরম খাঁ, কাজী নজরুল , মুজফফর আহমদ , সুরেশ মজুমদার , আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন, নূরজাহান বেগমেরা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই ভূমিকাকেই আরো মজবুত করেছেন বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, শহিদুল্লাহ কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত ,রণেশ দাশগুপ্ত ,সুধাংশু দাশগুপ্ত,শামসুর রাহমান, মতিউর রহমান( মাগসাইসাই জয়ী,’ প্রথম আলো’ র সম্পাদক) , কামাল লোহানি।

পশ্চিমবঙ্গে তথা গোটা ভারতেই গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের ভ্রুকুটিতে শাসকের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে।এই পর্যায়ে আজ ও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এক উজ্জ্বল ব্যাতিক্রমী ধারা বয়ে চলেছে। পাকিস্থান আমলে আইয়ুব , ইয়াহিয়ার আমলে প্রতিবাদ প্রতিরোধে যেমন সংবাদমাধ্যম অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, তেমনিই সামরিক জান্তার হাঁড়ি কাঠে মাথা গলানো সংবাদপত্র সেদিন, সেদেশে কম ছিল না।এই পর্যায় থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার ক্ষেত্রে শহিদুল্লাহ কায়সার, মতিউর রহমানদের যে লড়াই , সেই লড়াইকে নিজের পেশাগত দক্ষতা, সততা, দায়বদ্ধতার নিরিখে একটা পূর্ণমাত্রা দিয়েছিলেন কামাল লোহানি।আজ ভারতের প্রায় সবকটি সংবাদমাধ্যমই ( দি হিন্দু, গণশক্তির মতো হাতে গোনা কয়েকটি বাদ দিলে) এখন শাসকের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে কিন্তু এমন টা হয় নি।’ প্রথম আলো’ যে ভাবে শাসকের রক্তচক্ষুর তোয়াক্কা না করে যে কোনো রাজনৈতিক দলের শাসনকালেই মানুষের প্রতি চরম দায়বদ্ধতার পরিচয় দেখিয়ে চলেছে, তা বাংলাদেশের গোটা সংবাদমাধ্যমকে শিরদাড়া শক্ত করে চলবার সাহস জোগাচ্ছে। মতিউর রহমানের এই লড়াইয়ের পটভূমিকা তৈরিতে সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, কবীর চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, সুলতানা কামালদের যে ধারাবাহিক ঐতিহাসিক ভূমিকা, সেই ধারাবাহিকতার ই সঙ্গী ছিলেন কামাল লোহানি।

সোমেন চন্দ, সত্যেন সেন, কলিম শরাফি, রণেশ দাশগুপ্তদের রাজনৈতিক চেতনার সার্থক উত্তরসূরি কামাল লোহানি তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সংগঠনের নামকরণে সোমেনের বেছে নেওয়া নাম,’ ক্রান্তি’ র ব্যবহারের ভিতর দিয়ে ইতিহাসের প্রতি একটা বিরাট দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করেছেন।বস্তুত মহান মুক্তিযুদ্ধের কালে জহির রায়হান যখন ‘ স্টপ জেনোসাইড’ নামক ঐতিহাসিক তথ্যচিত্র টি তৈরি করেন তাঁর বন্ধু তথা ভারতীয় উপমহাদেশের মৌলবাদ , সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম আইকন সৈয়দ হাসান ইমামের সহায়তায় , তখন যে সার্বিক পরিমন্ডল দুই বাংলায় তৈরি হয়েছিল তাকে ইতিহাসের একটা পূর্ণমগ্নতার পথে সার্থক পদচারণা বলে উল্লেখ করা যায়।এই পদচারণাতে কামাল লোহানিও ছিলেন এক কৃতবিদ্য সৈনিক।

জহির রায়হান আর হাসান ইমামের মূল উদ্যোগে অত্যন্ত স্বল্প প্রযুক্তির ভিতর দিয়ে ‘ স্বাধীন বাংলা বেতার’ মহান মুক্তিযুদ্ধে গোটা বিশ্বের কাছে পাক হানাদার বাহিনির বিভৎসতাকে তুলে ধরেছিল।এই কাজে কামাল লোহানির ভূমিকা ও ইতিহাস কোনোদিন ভুলবে না।পরবর্তীতে যুদ্ধানরাধীদের বিচারের দাবিতে শহিদ জননী জাহানারা ইমাম যে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করেছিলেন, তার ও এক সার্থক সৈনিক ছিলেন কামাল লোহানি।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।