কলমের খোঁচা

ব্রজেন্দ্র শীল ও স্বদেশ চেতনার উন্মেষ।


গৌতম রায়: চিন্তন নিউজ:৪ঠা সেপ্টেম্বর:—– বাংলা তথা ভারতের স্বদেশ চেতনার উন্মোচনে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের (জন্ম- ৩রা সেপ্টেম্বর ১৮৬৪, মৃত্যু- ৩রা ডিসেম্বর ১৯৩৮) অবদান অবিস্মরণীয়। প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ না নিয়েও স্বদেশবাসীর ভেতরে জাতীয় চেতনার স্ফুরণে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ যেভাবে তাঁর গোটা জীবনকে পরিচালিত করেছিলেন, তা বিস্ময়ের বিষয়। এক অর্থে বলা যায়, বিশ শতকের সূচনালগ্নে, গোটা দেশব্যাপী জাতীয় চেতনার বিকাশে কিছু ব্যক্তিত্ব প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ না নিয়েও প্রধান ঋত্ত্বিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন।আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

বঙ্গভঙ্গের কালে, স্বদেশ চেতনার উন্মেষে জাতীয় শিক্ষার প্রসারকে প্রধান লক্ষ্য করে ভারতবর্ষের যেসব মনীষীরা তাঁদের বিচরণ ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করেছিলেন, তাঁদের ভিতরে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ ছিলেন বিশেষ রকমের উল্লেখযোগ্য। সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় জাতীয় শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে যে কার্যক্রম শুরু করেন, সেই কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান সহায়ক ছিলেন আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ। তাঁর সঙ্গেই গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজবিহারী ঘোষ, বিনয় কুমার সরকার, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখরা যুক্ত হয়েছিলেন।

এঁদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯০৬ সালে তৈরি হয়েছিল জাতীয় শিক্ষা পরিষদ। এই পরিষদের কর্মধারা নিয়ে আলাপ আলোচনা এবং ভবিষ্যতের ভাবনা নিয়ে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে মতামতের আদান প্রদান করতেন সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল প্রমুখেরা।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠা, প্রসার এবং কর্মধারার বিস্তার সম্পর্কে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদানের ক্ষেত্রে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের এই জাতীয় শিক্ষা প্রসারের কর্মকান্ডের প্রাথমিক পর্যায়ে বিনয় কুমার সরকার তিনটি গ্রন্থ লেখেন। এই তিনটি বইকে কেন্দ্র করে মূলত একটি শিক্ষা বিজ্ঞান শিবির অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিনয় কুমার সরকারের সেই তিনটি বইয়েরই ভূমিকা লেখক ছিলেন আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ।

বাংলায় জাতীয় আন্দোলনের বিশিষ্ট চরমপন্থী নেতা বিপিনচন্দ্র পালের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ প্রথম স্থাপিত হয় ১৯০১ সালে। একাধারে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি এবং ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার –দুটোর সঙ্গে কিন্তু বিপিনচন্দ্র পালের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম যুগে সংযোগ ছিল।

এই সময়কালের কর্মকাণ্ডের ভিতরে দাঁড়িয়ে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মনে করেছিলেন, এই ভারত মহাসাগরের তীরে, সভ্যতার দুয়ারে পুরাকাল থেকে আজ পর্যন্ত বহু জাতীয় সভ্যতা এসে মিলিত হয়েছে। সেই মিলন ভারতবর্ষের আদর্শকে আরো পরিপুষ্ট এবং পরিণত করেছে। কিন্তু সেই মিলনের বৈশিষ্ট্য কখনো হারায় নি এবং ভারতবর্ষ তার আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হয়নি। বিশ্বজনীন, সার্বভৌম আদর্শের ভারতবর্ষের ভাব, সেটাই হলো ভারতীয় সভ্যতার প্রাণ স্বরূপ। আজ বর্তমান জগৎ জড়ত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। এই শৃঙ্খলের ভেতর দিয়েই পরস্পরের প্রতি একটা ঘৃণা আর বিদ্বেষের গান গেয়ে চলেছে। সভ্যতা এখন ভারতের দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে। ভারতবর্ষের নতুন বাণী, নতুন তত্ত্ব আর সেই পূর্ণব্রহ্মজ্ঞান শোনার জন্য উৎকীর্ণ, উদগ্রীব।

গোটা দেশে যখন কংগ্রেসের প্রথম যুগের আবেদন-নিবেদন নীতির ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠছে, এক ধরনের চরমপন্থী ভাবধারা ক্রমশ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যপ্ত হচ্ছে, বিপিনচন্দ্র পাল, বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, অরবিন্দ ঘোষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন প্রমুখ নতুন ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটাচ্ছেন –এইরকম একটি সময় দাঁড়িয়ে জাতীয় শিক্ষার প্রসারের ভেতর দিয়ে স্বদেশ চেতনার উন্মেষের জন্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের যে সংযোগ — তা ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞান চেতনা, কুসংস্কারমুক্ত মানসিকতার বিকাশ, ভারতবর্ষের চিরকালীন ঐতিহ্যশালী সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার বিকাশ, সর্বোপরি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার মানসিকতার উন্মেষের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।

স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরের বন্ধুত্ব থাকলেও সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ডন সোসাইটির মাধ্যমে কিন্তু ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। নিবেদিতার বহু সশস্ত্র বিপ্লববাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথের অত্যন্ত মানসিক নৈকট্য ছিল। ব্রজেন্দ্রনাথের বহুমুখী পান্ডিত্যের প্রতি নিবেদিতাও ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান। নিবেদিতার মৃত্যুর পর ব্রজেন্দ্রনাথ লেখেন, ”নিবেদিতা ছিলেন বিবেকানন্দের উপসংহার।কিন্তু উপসংহার বলিয়া ঠিক বিবেকানন্দের প্রতিরূপ ছিলেন না। নিবেদিতা জীবনের সামান্য মাত্র স্পর্শ যাঁহারা পাইয়াছিলেন, তাঁহারাই সেই জ্যোতির্ময় জীবনের বিশালতা, গভীরতা ও শক্তি সঞ্চার দেখিয়া মুগ্ধ হইতেন। একটি দুর্লভ সর্বতোমুখী ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ আমরা পাই নিবেদিতার মধ্যে। নিবেদিতা চরিত্র এবং চিন্তায় দেখিয়াছি ভারতীয় ভাবধারা এবং সাংস্কৃতিক মহিমার সহিত আধুনিক ভাবধারাও উজ্জ্বলভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছিল। ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ না করিয়াও নিবেদিতা ভারতীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী হইয়াছিলেন- ইহা তাঁহার পক্ষে কম গৌরবের কথা নহে। ভারতের শিক্ষা কী, সাধনা কী, সমাজের মর্মকথা কী, তাহা তিনি যেমন করিয়া বুঝাইতে চাহিয়াছেন, যেমন করিয়া বুঝিলে আমরা যথার্থ ভারতীয় হইয়া উঠিতে পারি।– এক বিদেশিনীর পক্ষে এটা কম কৃতিত্বের কথা নহে।”

শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথের। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি দেখেছিলেন thrilling experience of saintliness হিসেবে। এক ‘মহাজাগতিক মানবতাবাদী’ রূপে। অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ব্রজেন্দ্রনাথ বলেছেন; শ্রীরামকৃষ্ণ মানুষের মধ্যে যেমন দেখেছেন ঈশ্বরকে, তেমনি ঈশ্বরের মধ্যে দেখেছেন মানুষকে। এটাই সব উপলব্ধি শেষ কথা। এই উপলব্ধিতে মানুষের মাঝেই দেখা যায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেকেও দেখা যায় মানুষের ভিতরে।
সকল জীবই তোমার কাছে ঈশ্বরের মূর্ত রূপ –ব্রজেন্দ্রনাথ শীল যে ‘মহাজাগতিক মানবতাবাদে’ র কথা বলেছেন, সেই ভাবনার সঙ্গে কিন্তু রামমোহন, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারার একটা অসাধারণ সামঞ্জস্য দেখতে পাওয়া যায়।

প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের ভাবধারার মধ্যে এক সমন্বয়ধর্মী ক্রমবিকাশের দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ জাতীয় আন্দোলনের প্রথম পর্বে, ভারতবর্ষের বিশেষ করে বাংলার মানুষদের মনে, জাতীয় শিক্ষাকে কেন্দ্র করে স্বদেশ চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। এই ভাবনার উপরে দাঁড়িয়ে তিনি সর্ব অর্থে এক সর্বজনীন মানবতাবাদকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যে দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের প্রতিটি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেবে ঐতিহ্যমন্ডিত বিশ্বজনীন সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের পরম্পরাকে। এই ভাবনার ভেতর দিয়েই জাতীয় আন্দোলনের সূচনা পর্বে মানুষের মধ্যে স্বদেশ প্রেমকে ভারতবর্ষের চিরকালীন বৈচিত্র্যময় সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার দ্বারা অনুপ্রাণিত করে, তাকে আধুনিক বিজ্ঞানমুখী, ঔপনিবেশিকতা বিরোধী, দেশীয় অর্থনীতির প্রতি বিশেষ মর্যাদা পূর্ণ একটা দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপিত করবার জন্য আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ তাঁর গোটা জীবনকে অতিবাহিত করে গেছেন।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।