মল্লিকা গাঙ্গুলি: চিন্তন নিউজ:২৮শে অক্টোবর:–ভারতের এন আর সি ইস্যু তে বারবার বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ।
বর্তমান ভারতীয় রাজনীতির একটি সাংঘাতিক স্পর্শকাতর বিষয় জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ বা এন আর সি। বর্তমান কেন্দ্র সরকার হঠাৎ করে এন আর সি ইস্যু এনে দেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যবাসীকে এক চরম অনিশ্চয়তার সামনে দাঁড় করিয়েছে।
ভারতের মানচিত্রে নজর দিলেই দেখা যাবে এ দেশের একেবারে পাশের বাড়ি হলো বাংলাদেশ। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যাবে এ যেন একই মায়ের দুই সন্তান । পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনের তাগিদে পৃথগন্ন! এখনও সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানে অবস্থিত দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত- বাংলাদেশ। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহরায় উল্লেখ করেছেন- “ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ঘোষণা করেছিলেন যারা ছিন্নমূল হয়ে এদেশে বসবাস করার জন্য এসেছেন তারা সন্দেহাতীত ভাবে অবশ্যই ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। এমনকি যদি কোনো আইনি সমস্যা তৈরি হয় সে আইনও পরিবর্তন করা হবে”। এই ভাবনা থেকেই প্রাক স্বাধীনতা থেকে সদ্য স্বাধীন ভারতে কোটি কোটি মানুষ এদেশে আশ্রয় পেয়েছে। তাদের স্থায়ী বসবাসের জন্য জমি (উদ্বাস্তু ভূমি) দান করে ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছে।
প্রায় শতবর্ষ ধরে বংশ পরম্পরায় এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার পরও মানুষগুলি আরও একবার ছিন্নমূল ঠিকানা বিহীন হতে চলেছে! বর্তমান ভারত সরকার সেই ঐতিহাসিক নীতির বিপরীতে নতুন আইন আনতে চেষ্টা করছে । তাই এন আর সি তে ভারতবাসী যেমন আতঙ্কিত, তেমনি উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ!!
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈঠকে কয়েক মিনিটের আলাপচারিতায় এন আর সি নিয়ে বাংলাদেশের শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই বলে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেন, এবং নরেন্দ্র মোদি মায়ানমারের রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় এবং মানবিক সহায়তায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসাও করেন। তাছাড়া গত ২০শে আগস্ট ঢাকা সফর কালে ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেন আসামের এন আর সি ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়। এই সমস্ত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক ভেবেই সে দেশের বিদেশমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন নরেন্দ্র মোদিকে উদ্ধৃত ক’রে তাঁর সরকারকে সান্তনা দিলেও বিজেপি সরকারের দ্বিচারিতা বাংলাদেশকে চিন্তামুক্ত করতে পারছে না! কারণ মোদি রাষ্ট্রপুঞ্জে আশার বাণী শোনালেও এই মাসেই নয়া দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আরও একদফা আলোচনা বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময়, সাতটি চুক্তি, এবং মৌ সাক্ষর, এমন কি যৌথ ভাবে তিনটি প্রকল্প উদ্বোধন হলেও এন আর সি প্রসঙ্গ উল্লেখই করা হয় নি। তার থেকেও বড় কথা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ্ লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজস্থানের এক জনসভায় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী দের কদর্য ভাষায় “উইপোকা” বলে উল্লেখ করে বলেন, “ওরা ভারতীয় যুবকদের রুটি রুজি চাকরি কেড়ে নিয়ে গরিবের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে”! শুধু রাজস্থান নয় দেশের বিভিন্ন সভায় জোর গলায় অনুপ্রবেশকারীদের আক্রমণ করেছেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মহঃ শকিউল্লাহ বলেন, উচ্চ মহল থেকে তার কাছে খবর আছে শুধু আসামে এন আর সি কারণে প্রায় ১৯ লক্ষ বাংলা ভাষী মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্ব হারাবে আর তাদের বেশিরভাগকেই অবৈধ বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে! তিনি জানান শুধু আসাম নয়, পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যে এন আর সি হবে বলেও জানিয়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্র বিভাগ।
মহঃ শফিউল্লাহ্রর মতে এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা শরণার্থী অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে ভারতের মৌখিক আশ্বাসে আস্থা রাখা যায় না, একমাত্র ভারত সরকারের লিখিত বিবৃতি পেলে তবেই ভারতের প্রতি আস্থা রাখা সম্ভব। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে মোদি সরকারের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। এন আর সি নিয়ে সে দেশের বিভিন্ন সভা সমিতি সেমিনারে আলোচনা চলছে। ভারতের মত বাংলাদেশেও সোস্যাল মিডিয়া সরগরম। এন আর সি ইস্যু তে ভারত বাংলাদেশ দু দেশেই বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী চিন্তা ভাবনা উঠে আসছে। বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মহলে বিস্তর দ্বিধা দ্বন্দ্ব এবং চাপান উতোর চলছ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেছেন, রাজনীতি ও সামাজিক সাম্প্রদায়িকরণ দেশের স্থিতিশীল অর্থনীতিতে ভারতের এন আর সির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ আর বিজেপি নেতারা চরম মুসলিম বিরোধী, বিজেপি নেতাদের ইসলাম বিরোধী বক্তব্য এ দেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেও উস্কে দিতে পারে। এন আর সি ইস্যু সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণু চেতনাকে উসকানি দেয়। তাই সাম্প্রদায়িকতা রুখতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই হতে পারে অন্যতম পদক্ষেপ। বাংলাদেশের সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেছেন, ভারতের এন আর সি ইস্যু তে বাংলাদেশের এখনি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মায়ানমারের ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা নিয়ে দেশ এখনই এক জটিল সমস্যায় জর্জরিত তার উপর এন আর সি চাপ কিভাবে মোকাবিলা করবে তা এখনই ভাবা দরকার।
অপর দিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালক ও ডেটাবেস কার্যক্রমের প্রধান সেলিম মাহমুদ বলতে চান, ভারতের এন আর সি ইস্যুতে দেশের ভিতরে কিছুটা উৎকন্ঠা থাকলেও তিনি বিশ্বাস করেন শেষ পর্যন্ত ভারত এমন কিছু করবে না যা দেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কারন ভরত আর মায়নামার এক নয়! যে ভারত বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করেছে যে ভারত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মাত্র তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করেছে সেই ভারত কখনোই বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান নেবে না বলেই মাহমুদ বিশ্বাস করেন!! বাংলাদেশের এই বিশ্বাস স্থায়ী হোক।
বিজেপি সরকারের এই এন আর সি নামক আভ্যন্তরীণ বিষয় দেশের আইনের দ্বারা দেশের ভিতরেই সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়, কারণ এই সাম্প্রদায়িক ইস্যু ভারতের জন্য কোনো ভয়ংকর আন্তজার্তিক সমস্যা হয়ে না ওঠে। বিশ্বের মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলি বাংলাদেশের সঙ্গে একজোট হয়ে হিন্দু রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করে ভারত কে ধ্বংসের সুযোগ না হয়ে ওঠে এই এন আর সি। তাই ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। বড় কথা হলো- বিশ্ব ভাতৃত্বের বন্ধনে বিশ্বমানবতা কে মূল্য দিয়ে সমস্ত কাঁটা তারের বেড়া ভেঙে এ পৃথিবী হোক মানুষের নিজের।
শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন রাজনীতিবিদদের সাফ কথা বিশ্বজুড়ে কিসের এন আর সি ,কিসের বর্ডার…..বিশ্ব জুড়ে থাকবে মানুষ, পৃথিবীটা জনতার!!