তুলসী কুমার সিনহা: চিন্তন নিউজ:১৬ই এপ্রিল:- বিশ্বের মানুষের কাছে খুব প্রিয় ও পরিচিত নাম চার্লি চ্যাপলিন। পরনে জরাজীর্ণ কোট-টাই, ঢিলেঢালা মলিন প্যান্ট, মাথায় কালো রঙের ডার্বি হ্যাট, হাতে একটি ছড়ি, পায়ে পুরোনো এক জোড়া বুট এবং ঠোঁটের উপর খাটো অথচ প্রশস্ত একটুখানি টুথব্রাশ গোঁফ – এই লোকটাকে সবাই চেনে! তিনি সকলের প্রিয় মূকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন।
চার্লি চ্যাপলিনের প্রকৃত নাম ‘চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন’। যদিও তাকে বিশ্বব্যাপী ‘শার্লট’, ’কার্লিটোস’, ‘দ্য লিটল ট্র্যাম্প (ভবঘুরে)’ ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।। তাঁর জন্মতারিখ ও জন্মস্থান নির্ভুলভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হয়, তিনি ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের ওয়ালউওর্থে জন্মগ্রহণ করেন।
চার্লি চ্যাপলিনের বাবা ছিলেন ‘চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র’ এবং তার মায়ের নাম ‘হানাহ চ্যাপলিন’। তারা দুজনই একাধারে মঞ্চে অভিনয় করতেন এবং পাশাপাশি গানও গাইতেন।চার্লিরা দুই ভাই মায়ের কাছে গানের ও অভিনয়ের তালিম নিয়েছিলেন। চার্লি চ্যাপলিনের শৈশব কেটেছে চরম অভাব-অনটন ও নিদারুণ কষ্টের মাঝে। বারো বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তিনি যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন, অনেক মানুষকে পুরো জীবদ্দশাতেও সেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় না। তার বয়স তিন বছর হওয়ার পূর্বেই তার বাবা-মা আলাদা বসবাস করা শুরু করেন; যদিও তাদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়নি। শিশু চ্যাপলিন তার মায়ের সাথে থাকতেন; সাথে ছিলো তার সৎ বড় ভাই ‘সিডনি চ্যাপলিন’।তার বয়স যখন সাত বছর তখন তার মা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে চার্লি চ্যাপলিনকে প্রথমে একটি অনাথাশ্রমে ও পরবর্তীতে দুঃস্থ শিশুদের জন্য ‘সেন্ট্রাল লন্ডন ডিস্ট্রিক্ট স্কুলে’ পাঠানো হয়।
প্রায় দু’বছর পরে চ্যাপলিনের মা সুস্থ হয়ে উঠলে চ্যাপলিন মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। কিন্তু চার্লি চ্যাপলিনের মা হানাহ চ্যাপলিন আর কোনোদিনই সুস্থ হয়ে উঠেননি। মায়ের মৃত্যুর পর চ্যাপলিনকে কিছুদিনের জন্য তার মদ্যপ বাবার কাছে গিয়ে থাকতে হয় । সেখানে বেশি দিন ঠাঁই হয়নি বালক চ্যাপলিনের। অভাবের তাড়নায় পৈতৃক সুত্রে পাওয়া মঞ্চে অভিনয় করার আগ্রহ থেকে মাত্র আট বছর বয়সেই তিনি যুক্ত হন ‘দ্য এইট ল্যাঙ্কাশায়ার ল্যাডস’ নামক একটি যাত্রাদলের সাথে।
মূলত এখান থেকেই তার কর্মজীবন শুরু হয় এবং প্রথম থেকেই বালক চার্লি চ্যাপলিনের মঞ্চাভিনয় দর্শক ও আয়োজকগনকে মুগ্ধ করে। এরপর চ্যাপলিন ছোটখাট আরও নানা মঞ্চে নিজের অভিনয় ক্ষমতার মাধ্যমে সুনাম কুড়াতে থাকেন। ফলস্বরূপ পরবর্তী জীবনে তিনি তৎকালের কিছু নামকরা চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে অভিনয় ও চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন।
মাত্র আট বছর বয়সে কর্মজীবনে প্রবেশ করে চ্যাপলিন একের পর এক অভিনয় দিয়ে মানুষের মন জয় করে নিলেও তার আর্থিক দুর্দশা পুরোপুরি কাটেনি। তিনি কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাই তিনি হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছিলেন। তিনি যেহেতু অভিনয় পছন্দ করতেন, তাই তার প্রথম ইচ্ছা ছিলো অভিনয় সংক্রান্ত কোনো কাজ।
অবশেষে তিনি ১৯০৮ সালে আঠারো বছর বয়সে ‘দ্য কার্নো কোম্পানি’তে তিনি যোগদান করেন। তখনকার দিনে ব্রিটেনের এই স্বনামধন্য কোম্পানিটি হাস্যরসাত্মক নাটক তৈরি করতো ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে সেগুলোর প্রদর্শনী করে বেড়াতো। এই কোম্পানিতে যোগদান করে চ্যাপলিন নিজেকে প্রমাণ করার ও বিশ্ববাসীর সামনে নিজেকে মেলে ধরার একটা সুযোগ পেয়ে যান, যা তিনি ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন।
তার অসাধারণ স্টেজ পারফর্মেন্সে মুগ্ধ হয়ে ১৯১০ সালে তাঁকে মঞ্চনাট্য প্রদর্শনীর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করে ‘দ্য কার্নো কোম্পানি’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়।দু’বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে নিজের অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা প্রদর্শন করার পর তিনি ইংল্যান্ড ফিরে এলেও তাঁকে আবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয় ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চ্যাপলিনকে তাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালে অনেক ভেবেচিন্তে চ্যাপলিন ‘কিস্টোন স্টুডিও’তে কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। তার পর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয়নি।তার সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়েছিলো ১৫০ ডলার। এই স্টুডিওর অধীনেই তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেকিং এ লিভিং’ (১৯১৪) মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রে মূখ্যভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন চ্যাপলিন নিজে।চার্লি তার কাজকে ভালোবাসতেন। দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে তার পারিশ্রমিকের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগলো।
প্রথমদিকে, তিনি অন্যান্য পরিচালকদের পরিচালনায় অভিনয় করলেও পরবর্তীতে পরিচালনার ভার নিজের হাতে তুলে নেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। তিনি একের পর এক স্বনামধন্য চলচ্চিত্র-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে বিভিন্ন মেয়াদে চুক্তিবদ্ধ হতে থাকলেন। তিনি কাউকে হতাশ করেননি; একের পর এক মাস্টারপিস তার হাত ধরে বের হতে লাগলো। তিনি তখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম।
চ্যাপলিনের জনপ্রিয়তা ও তার কাজের গুণগত মান প্রশ্নাতীত। তিনি মার্কিন চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের মাত্র তিন বছর পর, ১৯১৬ সালে ‘দ্য মিউচুয়াল ফিল্ম কর্পোরেশন’ এর সাথে একটি চুক্তি সম্পন্ন করেন। যার শর্ত হলো, চার্লি চ্যাপলিন নিজের ইচ্ছামতো ১২টি চলচ্চিত্র তৈরি করে দেবেন এবং বিনিময়ে কাজ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত তৎকালীন মুদ্রায় বার্ষিক ‘ছয় লক্ষ সত্তর হাজার’ মার্কিন ডলার করে পাবেন! তিনি আঠারো মাসে চুক্তির শর্ত পূরণ করেন এবং মিউচুয়াল কর্পোরেশনকে উপহার দেন ১২টি মাস্টারপিস চলচ্চিত্র।এরপর তিনি ‘ফাস্ট ন্যাশনাল’ কোম্পানির সহায়তায় নিজস্ব স্টুডিও তৈরি করে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করেন।
তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো:
মেকিং এ লিভিং (১৯১৪),দ্য কিউর (১৯১৭)
দ্য অ্যাডভেঞ্চারার (১৯১৭),এ ডগ’স লাইগ (১৯১৮),দ্য কিড (১৯২১),দ্য গোল্ড রাশ (১৯২৫)
দ্য সারকাস (১৯২৮),সিটি লাইটস (১৯৩১)
দ্য গ্রেট ডিক্টেটর (১৯৪০) প্রভৃতি।চার্লি চ্যাপলিন স্টেজ শো বাদ দিলে , অভিনয় করেন প্রায় ৪৯ টি সিনেমা তে । সিনেমার প্রযোজনা করেছেন ৩১ টি সিনেমার। মুক্তি পায় নি বা অসমাপ্ত থেকে গেছে ৪ টি সিনেমা ।
এছাড়াও প্রযোজনা এবং পরিচালনা চ্যাপলিনের নয়, অথবা তাঁর বিনা অনুমতিতে বেশ কিছু ছবি বিভিন্ন নতুন নামে মুক্তি পেয়েছিল । সেই সংখ্যা ১৭ ।
অতিথি শিল্পী হিসেবে চ্যাপলিন অভিনীত চলচ্চিত্র- র সংখ্যা ৭.
চ্যাপলিন এর সমগ্র জীবনী নিয়ে তথ্য চিত্রের সংখ্যা অগুনতি হলেও উল্লেখযোগ্য তিন টি হলো দি জেন্টলম্যান ট্রাম্প, দি ফানিয়েষ্ট ম্যান ইন দি ওয়াল্ড এবং দি আন নোন চ্যাপলিন।
চার্লি চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রগুলোর কয়েকটি বাদে তার বাকি সবগুলোই নির্বাক কমেডি চলচ্চিত্র। তিনি মূলত হাস্যরসাত্মক ঘরানার সিনেমা বানালেও, পরবর্তীতে তার চলচ্চিত্রে অন্যান্য মাত্রা যেমন ট্রাজেডি, রোম্যান্স ইত্যাদি যোগ হতে থাকে।
চার্চিলের প্রতিটি চলচ্চিত্রেই তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, জীবনদর্শন ও পর্যবেক্ষণ কোনো না কোনোভাবে উঠে এসেছে।সমাজ সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল অতি গভীর।তাঁর জীবনদর্শনের রাজনীতিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি জীবন থেকে রাজনীতিকে আলাদা করতে পারেন নি বলে বারবার তাঁকে সমালোচনায় জর্জরিত হতে হয়।তাঁর প্রথম সন্তানের মৃত্যুর দুই বছর পরই মুক্তি পায় ‘দ্য কিড’ চলচ্চিত্রটি। যেখানে দারিদ্র্য, বাবা-মা’র বিচ্ছেদ ও এক শিশুর অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়। স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা থেকেই অনুধাবন করে নেওয়া যায়, এই চলচ্চিত্রটির অণুপ্রেরণা চার্লির শৈশব ও পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেওয়া তার সন্তানের স্মৃতি থেকেই এসেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মাতৃভূমির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করেন নি বলে ব্রিটেনব্যাপী চার্চিলের সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।১৯২৯ সালে চার্চিলের তৈরি মাস্টারপিস চলচ্চিত্রে পুঁজিবাদের সমালোচনা করায় তিনি রাজনীতিবিদ ও গোয়েন্দা সংস্থার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। আমেরিকানরা চার্চিলের কাজে রাজনীতির গন্ধ খুঁজে পায়।১৯৪০ সালে তিনি ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ তৈরি করেন।এই চলচ্চিত্রে তিনি হিটলারকে ব্যঙ্গ করে ফ্যাসিবাদী সরকারের সমালোচনা করেন। মার্কিনীরা চার্চিলের মধ্যে বামপন্থা খুঁজে পায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন চার্চিল বিভিন্নভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন করেন।এরপর মার্কিন কর্তৃপক্ষ চার্চিলের তৈরি করা পূর্বের চলচ্চিত্রের মধ্যে সমাজতন্ত্রের উপাদান খুঁজে পায়। রাজনীতিবিদরা চার্চিলকে আমেরিকা থেকে নির্বাসনের দাবি জানাতে থাকেন। অবশেষে তিনি ১৯৫২ সালে আমেরিকা ত্যাগ করে ইংল্যান্ড এ ফিরে আসেন।১৯৭৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর সুইজারল্যান্ডে এই মহান মানুষটি প্রয়াত হন।